অধিকার ও মর্যাদাএক্সক্লুসিভধর্ম ও জীবন

ইসলামে জাকাত কখন, কার উপর ফরজ ও জাকাতের গুরুত্ব

‘জাকাত’ ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের একটি। জাকাত অস্বীকারকারি নিঃসন্দেহে কাফির। বান্দার বৈধ উপার্জন থেকে একটি ‘নির্দিষ্ট পরিমাণ’ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করার নাম ‘জাকাত’।আল্লাহ তা’আলা কোরআন মজিদে এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় (জাকাত দাও) কর।’ (সূরা বাক্বারা ২৬৭ নং আয়াত)

হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণেত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি। এক- এ কথার স্বাক্ষ্য দেওয়া যে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই আর নিশ্চয়ই মোহাম্মদ (সা.) তাঁর সন্মানিত বান্দা ও রাসূল, দুই- সালাত কায়েম করা, তিন- জাকাত আদায় করা, চার- হজ করা, পাঁচ- রমজানে রোজা রাখা। (সহিহ বুখারী)

সূরা বাইয়্যিনাহ এর ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা একাগ্রচিত্তে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা’র এবাদত করবে, যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে, জাকাত প্রদান করবে, আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’

আরেক হাদিসে আছে- হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মহানবী (সা.) হযরত মু’আয (র.)কে এয়ামানের শাসক হিসেবে পাঠানোর সময় বলেন, সেখানের অধিবাসীদের তুমি ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই ও আমি আল্লাহর রাসূল এই স্বাক্ষ্যদানের দাওয়াত দেবে।

যদি তারা একথা মেনে নেয় তাহলে তাদের জানিয়ে দেবে আল্লাহ তাদের উপর প্রতিদিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ যদি তারা একথাও মেনে নেয় তবে তাদের জানিয়ে দেবে আল্লাহ তাদের সম্পদের পর সদকা (জাকাত) ফরজ করেছেন। তাদের মধ্যকার (নিসাব পরিমাণ) সম্পদশালীদের নিকট থেকে (জাকাত) সংগ্রহ করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারী)

ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। জাকাত দিলে সম্পদ কমে যায় না বরং বৃদ্ধি পায়। এটি আপনার উপার্জিত ও জমারাখা সম্পদকে পবিত্র করে। জাকাত আদায়কারির পুরষ্কার হচ্ছে আল্লাহ সন্তুষ্টি, আখেরাতে মুক্তি ও জান্নাত।জাকাত আদায়কারীর জন্য জাকাত দেওয়াকে দয়া দাক্ষিণ্য হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।

মালের নেসাব পরিমাণ জাকাত আদায় করা ‘দয়া নয়’ বরং ‘গরিবের হক’। ইসলামী শরীয়ত মতে সুষ্ঠুভাবে জাকাত বন্ঠন করা গেলে দারিদ্রমুক্ত একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। জাকাত ধনী ও গরীবের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনে।

হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাঁপের আকৃতি দান তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুপাশে কামড়ে ধরে বলবে- আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল।

তারপর রাসূল (সা.) তেলাওয়াত করেন, আল্লাহ যাদের সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পন্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং উহা তাদের জন্যই অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পন্য করেছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে। (সহিহ বুখারী)

মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘‘যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর”। সূরা আত-তওবা: (৩৪-৩৫)

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরজ। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বছরের যাকাত প্রদান করা ফরজ।

অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি যদি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়েও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। যাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি তা প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।

জাকাত কখন, কিভাবে আদায় করতে হবে এবং কার উপর ফরজ করা হয়েছে তা রাসূলে পাকের হাদিস দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে। কাকে দিতে হবে তা তো স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনে বলে দিয়েছেন।হযরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পাঁচ উকিয়া (এক উকিয়া = ৪০ দিরহাম, আর ৫ ‍উকিয়া = ২০০ দিরহাম, এই দিরহামকে এবার বাংলা টাকায় গণ্য করতে হবে)পরিমাণের কম সম্পদের উপর যাকাত নেই এবং পাঁচটি উটের কমের উপর যাকাত নেই। পাঁচ ওসাক (পাঁচ ওসাক =৩শ সা, এক সা = প্রায় তিনসের ১১ছটাকের সমান) এর কম উৎপন্ন দ্রব্যের উপর যাকাত নেই। (সহিহ বুখারী)

আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘’সোনা বিশ দিনার পরিমাণ হলে তাতে জাকাত ফরজ হবে।’রাসূল (সা.) এর এর হাদিস মতে এই নিসাব পরিমাণ সম্পদের জাকাত দিতে হবে।শরিয়তের ইমামগণ এভাবেই জাকাত নির্ধারণের কথা বলেছেন, এক, সোনা-রুপা (টাকা): স্বর্ণের নিসাব হল ২০ দিনার। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত ইসলামী পরিমাপ পদ্ধতিতে এক দিনার সমান এক মিছকাল। ১ দিনার = ১ মিছকাল = ৪.২৫ গ্রাম, সুতরাং ২০ দিনার = ২০ মিছকাল = ৮৫ গ্রাম।

যা এ দেশীয় পরিমাপে ৭.৫ ভরি হয়। এখন ২২ ক্যারটে ভরি ধর্তব্য হলে আর প্রতিগ্রাম স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য ধরে সে হিসেবে গনণা করলে ৮৫গ্রাম /৭.৫ ভরি স্বর্ণের দাম যা আসে তাই জাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। (স্বর্ণের বাজারমূল্য ০০০০*৮৫= ০০০০ টাকা। ২.৫ % হারে আপনাকে যাকাতের টাকা পরিশোধ করতে হবে ।

রূপার নিসাব হলো পাঁচ উকিয়া। এক উকিয়া = ৪০ দিরহাম। সে মতে রূপার নিসাব হল পাঁচ উকিয়া = ২০০ দিরহাম। আর এক দিরহাম হল এক মিছকালের সাত দশমাংশ, এর মোট ওজন ১৪০ মিছকাল, যার বর্তমান প্রচলিত ওজন হল, ৫৯৫ গ্রাম। যা এ দেশি পরিমাপে ৫২.৫ ভরি, তা থেকে ৪০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত দেয়া ফরজ।

ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী এমন প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর জাকাত আদায় করা ফরজ, যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যায়- ১. মুসলিম ২. স্বাধীন ৩. আকেল হওয়া ৪. বালেগ হওয়া ৫. নিসাব পরিমান সম্পদ থাকা ৬. পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকা ৭. সম্পদের মালিকানা পূর্ণ একবছর অতিবাহিত হওয়া ।

(সুতরাং অমুসলিম, পরাধীন ক্রিতদাস, উন্মাদ (পাগল), অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালেগ, নিসাবের চেয়ে কম পরিমানে সম্পদের অধিকারী, যৌথসম্পত্তিতে এককভাবে নিসাব পরিমানে সম্পদের মালিক না হওয়া, নিসাব পরিমান সম্পদ পূর্ন একবছর মালিকানায় না থাকলে তার উপর জাকাত ফরজ নয়)। 

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button