এক্সক্লুসিভখুলনাপরিবার ও দাম্পত্যপ্রবাসবাংলাদেশমধ্যপ্রাচ্য

সৌদিপ্রবাসীর মৃত্যুর প্রায় এক বছর, এখনো লাশ বুঝে পায়নি পরিবার

মনির শেখ কাজের সন্ধানে সৌদি আরব গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। আর কদিন পরই বাড়ি আসবেন বলে নতুন করে পাসপোর্ট করেছেন। ছুটি নিয়েছেন মালিকের কাছ থেকে। পাসপোর্ট অনুযায়ী মনির শেখের বয়স ৪০ হলেও তাঁর স্ত্রী জেছমিন বেগম বললেন, আসল বয়স ৫০–এর কাছাকাছি। সৌদি আরব গিয়েছিলেন দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে। নড়াইলের মাহাবুর বিশ্বাস, মাসুদ বিশ্বাস ৯০ দিনের ফ্রি ভিসায় রিয়াদে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন।

সৌদি আরবের রিয়াদে কাজের জায়গায় তেমন সুবিধা হচ্ছিল না। সেখানে বাংলাদেশি আরও কয়েকজন নির্মাণশ্রমিককে পেয়েছিলেন মনির শেখ। জায়গা পরিবর্তন করে তাঁদের সঙ্গে ২০১৯ সালে রিয়াদ থেকে চলে যান আল-কাসিম প্রদেশে। সেখানকার বুরাইদাহ শহরে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে শুরু হয় তাঁর জীবন।

এ শহরেই একসঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন কয়েকজন মিলে। দেশে আসার জন্য টুকটাক করে জিনিসপত্র কিনছিলেন মনির। নাতির জন্য খেলনা, ছেলের জন্য জামা। একটু একটু করে গোছাচ্ছিলেন বাড়ি ফেরার ব্যাগটা। এর মধ্যে অসুস্থ হলেন, একটু একটু জ্বর। বুকে ব্যথা আছে। ভিডিও কলে কথা বলার সময় সেদিন সকালে উত্তরপাড়ার ওই বাড়ির বাসিন্দাদের একটু মন খারাপ হয়েছিল তাঁকে দেখে।

মিলিনার নতুন ফোনে ঝকঝকে ছবি ওঠে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মিলিনাকে টাচ স্ক্রিন এই ফোন কিনে দিয়েছেন সৌদিপ্রবাসী বাবা। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস করতে পারছিল না মেয়েটা। সেই সমস্যার সমাধানে ফোনটি কিনে দেন বাবা। তবে নতুন ফোনের সুবাদে আরেকটা সুবিধা হয়েছিল। কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে বাবাকে দেখাও যেত।

খুলনার তেরখাদা উপজেলার উত্তরপাড়া গ্রামের এক বাড়িতে প্রতিদিন সকালে সব ছেলেমেয়ে একসঙ্গে গোল হয়ে বসত ভিডিও কলের জন্য। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি প্রবাসী মনির শেখ কর্মস্থলে যাওয়ার আগে রোজ সকালে সবাইকে একনজর দেখতেন। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট সকালেও কথা বলেছেন সবার সঙ্গে।তখনো কারও ধারণা হয়নি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।

মনিরের স্ত্রী জানালেন, সৌদি আরব যাওয়ার টাকা জোগাড় করা হয়েছিল ধার করে। এর মধ্যে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এখনো শোধ হয়নি। তবু চার বছর ধরে পরিবারের মানুষদের কাছে না পেয়ে মনির অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন দেশে ফেরার জন্য। তাই কিছুদিনের জন্য বাড়ি আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

সৌদিতে যাওয়ার সময় ছোট ছেলে রনির বয়স ছিল মাত্র চার বছর। সেজ সন্তান জনি এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। আর মেজ মেয়ে মিলিনা শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। বড় মেয়ে অন্তরার বিয়ে হয়েছে, তাঁর ঘরে সন্তান এসেছে। এই নাতিকে কোলে নেওয়ার জন্য অস্থির ছিলেন মনির।

২০২১ সালের ৩০ আগস্ট ভিডিও কলে কথা বলার সময় পরিবারের মনে হয়েছিলো মানুষটার শরীর খারাপ হয়েছে, ওজন কমেছে অনেক। তবু পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পরিবারের জন্য। নিজের অসুবিধা হচ্ছে না বলে মনির আশ্বস্ত করেছিলেন সবাইকে। ভিডিও কলে কথা বলার এক ঘণ্টা পরই আবার ফোন আসে সৌদি আরব থেকে। মনির শেখ মারা গেছেন। 

প্রথমে শোকের ছায়া। এরপর শুরু হয় রহস্য। মনিরের মেস বাসার অন্য বাসিন্দারা একবার জানিয়েছেন, বেশি অসুস্থ হওয়ায় মনিরকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে মারা যান। আবার বলেছেন, তিনি বাসায় মারা গেছেন। তাঁদেরই একজন আবার মনিরের পরিবারকে একটি ছবি পাঠিয়ে বলেছেন, বাসায় তাঁকে এ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়।

মেঝেতে পাতা বিছানায় উপুড় হয়ে আছে মনিরের মরদেহ। এরপর শুরু হয় মরদেহ নিয়ে আরেক পর্ব। বাসিন্দাদের একজন জানালেন, মরদেহ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। আরেকজন জানিয়েছেন, পুলিশ বুরাইদাহর থানার হিমঘরে রেখেছে। সেখান থেকে টাকা দিয়ে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

চার সন্তানের মা জেছমিন গিয়েছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে এ কাজের জন্য সরকারি বরাদ্দ নেই। তবু কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, চেষ্টা করছি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর সাহায্য চেয়ে একটি দরখাস্ত পাঠানো হয়েছে। সমস্যা আরও আছে। পরিবার নিশ্চিত করে বলতেই পারছে না, মরদেহটি কোথায় আছে।’

স্বামীর লাশ দেশে আনার কোনো উপায় পেতে মনিরের স্ত্রী জেসমিন বেগম খুলনার তেরখাদা থেকে এসেছিলেন রাজধানীর কাকরাইলের বোরাক টাওয়ারের একটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু এখানেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। নেই মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার অর্থ।

আবার স্বামীর মরদেহ ঠিক কোথায় রাখা আছে, সে ঠিকানাও জানেন না জেছমিন। এর মধ্যে সৌদি আরবে মৃত স্বামীর মেসের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেছেন, পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে স্বাক্ষর রেখেছে। মনির শেখের কিছু টাকা তাঁদের কাছে জমা রাখা থাকলেও এখনই তা দেওয়া সম্ভব নয়।

হাসপাতাল, পুলিশের খরচ মেটাতেই তাঁদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। বুরাইদাহ শহরের সেই মেসের বাসিন্দাদের একজন সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তবে তিনি এই পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করতে রাজি নন বলে জানালেন জেছমিন বেগম।

কথা হয় মনিরের মেজ মেয়ে মিলিনার সঙ্গে। মিলিনা বলেছে, ‘আব্বুকে নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। দম আটকে আসে। আর মাত্র কয়েক দিন পর দেশে আসত। যে ফোনে কথা বলতিছি, সেটা কিনতে আব্বু টাকা পাঠাইছিল। এই ফোন দিয়ে আব্বুরে দেখতাম। মারা যাওয়ার একটু আগেও দেখছিলাম। এখন মৃত মানুষটারেও দেখার ভাগ্য নাই আমাদের। এক বছর ধরে শুধু অপেক্ষাই করতিছি।’

মনির শেখের ভাই তরিকুল শেখ বলেছেন, সৌদি আরবে যাওয়ার আগে তাঁর ভাই এলাকার বিলে মাছ ধরতেন। ছোটখাটো ব্যবসার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু সংসার আর চলছিল না। সৌদি আরব যাওয়ার সময় দালালেরা বলছিল, কোম্পানির হয়ে কাজ পাবে, তাই বেশি টাকা লাগবে। কিন্তু ভাই সৌদি আরবে কাজ শুরু করেন খেজুরবাগানে। আকামা করতে লাখখানেক টাকা লাগে, কিন্তু দালালেরা তাঁর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে নেয়।

পরিবারে সচ্ছলতা আনার আশায় সৌদি আরবে গিয়ে মনির শেখ কতখানি ধোঁকা খেয়েছেন, বলা কঠিন। তবে মৃত্যুর পরও যে তাঁর নিস্তার হয়নি, তা স্পষ্ট। প্রায় এক বছর ধরে তাঁর মরদেহ রয়েছে অন্য দেশের কোনো এক হিমঘরে। বেঁচে থাকতে ফেরা তো হয়নি তেরখাদার বাড়িতে। মৃত্যুর পরও পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারেনি মনির শেখের মরদেহ।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button