অর্থ ও বাণিজ্যবাংলাদেশব্যাংকিং

আগামী বছর ২০২৩ সাল মন্দার দিকে ঝুকছে বিশ্ব অর্থনীতি

অর্থনৈতিক সংকটে সারা বিশ্ব।তাই দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়তে গিয়ে দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একই সময়ে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় আগামী বছর বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।

নতুন এক প্রতিবেদনে আর্থিক খাতের এই আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একই সময়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিন অর্থনীতির অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবৃদ্ধির গতি অনেকটা স্লথ হয়ে এসেছে। এ অবস্থায় ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতি সামান্য ঝাঁকি খেলেও সেটা বিশ্ব মন্দার কারণ হতে পারে।

‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। মূল্যস্ফীতি কমাতে চলতি মাসেই বৈঠকে বসছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। এই বৈঠক সামনে রেখেই বিশ্বব্যাংক গবেষণাটি করেছে।

ওয়াশিংটন থেকে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ। এই তিন শক্তির অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি হারাচ্ছে। এর মধ্যে আগামী বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মাঝারি কোনো আঘাত এলেও তার পরিণতি গড়াতে পারে মন্দায়। এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একইসঙ্গে যে মাত্রায় সুদের হার বাড়িয়েছে, গত পাঁচ দশকে তা দেখা যায়নি। এই প্রবণতা আগামী বছর পর্যন্ত চলতে পারে।বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, সরবরাহ ব্যাহত না হলে এবং শ্রম বাজারের চাপ কম না হলে সুদের হার ওই পরিমাণ বৃদ্ধিতে আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা গড়ে মহামারী শুরুর আগের পাঁচ বছরের গড়ের প্রায় দ্বিগুণ।

বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মুদ্রানীতিতে সুদের হার প্রায় ৪ শতাংশে উন্নীত করবে, যা ২০২১ সালের গড় তুলনায় ২ শতাংশ পয়েন্টের বেশি।

বিশ্বব্যাংকের শঙ্কা, একে তো চলছে অর্থনৈতিক সংকট, তারপর সুদের হার বৃদ্ধির এই পরিমাণ ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মাথাপিছু আয় সংকোচন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিকেই সংজ্ঞাগতভাবে বৈশ্বিক মন্দা বলা হয়ে থাকে।

বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য বলছে, সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এই অঙ্কটা করোনা মহামারির আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এ নিয়ে বলছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে আসছে। ভবিষ্যতে যখন বিভিন্ন দেশ মন্দার কবলে পড়বে, তখন এই গতি আরও কমে আসতে পারে। ডেভিড ম্যালপাসের শঙ্কা, প্রবৃদ্ধি কমে আসার যে হাওয়া বইছে, তা অব্যাহত থাকবে। এর মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে।

ডেভিড ম্যালপাসের ভাষ্যমতে, আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত নীতিনির্ধারকদের। একই সঙ্গে তাঁদের বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া কতটা ঝুঁকির হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে ১৯৮২ সালের মন্দার। তখন বিভিন্ন দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারানোর ৪০টির বেশি ঘটনা ঘটেছিল। এ ছাড়া উন্নয়নশীল অনেক দেশ এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারিয়েছিল।

শ্রম-বাজারের সীমাবদ্ধতা কমানো, বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহে বৈশ্বিক সমন্বয় এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

এর আগে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফও এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতির চাকা আরও স্লথ হয়ে যাওয়ার ইংগিত দিয়েছে।জুলাই মাসের প্রাক্কলনে আইএমএফ বলেছিল, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২.৯ শতাংশ বাড়তে পারে। আগামী মাসে নতুন প্রতিবেদনে সংশোধিত হার প্রকাশ করবে তারা।

বিশ্বব্যাংক গবেষণায় মূলত বৈশ্বিক প্রবণতাকেই তুলে ধরেছে। সেখানে নির্দিষ্ট কোনো দেশের কথা উল্লেখ নেই। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বিশ্বমন্দা হলে বাংলাদেশ এর বিরূপ প্রভাব থেকে বাইরে থাকতে পারবে না। তবে বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশকে কিছু সুবিধাও দেবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলা ম্যাগাজিন /এমএ

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button