এক্সক্লুসিভচট্টগ্রামবাংলাদেশবিএনপিরাজনীতি

কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণে বাঁচলেও ঠান্ডা মাথার বুলেটে পা হারান চট্টগ্রামের এক যুবক

কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণে বাঁচলেও ঠান্ডা মাথার বুলেটে পা হারান সাইফুল নামের চট্টগ্রামের এক যুবক। পুলিশের পাঠানো প্রেস রিলিজের বরাত দিয়ে ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রচারিত হলেও ঘটনাটি যাচাই করতে গিয়ে জানা গেল চাঞ্চল্যকর কাহিনী।

‘বন্দুকযুদ্ধ’— এই শব্দবন্ধের সঙ্গে মোটামুটি সবাই পরিচিত। থানায় আটক বন্দিকে নিয়ে কথিত অস্ত্র উদ্ধার, গুলি-পাল্টা গুলির মাঝে পড়ে এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান বন্দি। প্রাণ না হারালেও অনেকেই হারান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ‘বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে’ এমন ঘটনা ঘটে— প্রতিবার এমনটিই দাবি করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।

সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে আছে প্রায় দেড় ডজন মামলা। যদিও অপরাধজগতের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা আছে— এমন দাবি পুলিশ করলেও সাইফুলের অভিযোগ, বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার কারণেই তাকে জড়ানো হয়েছে একের পর এক মামলায়। তার অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণেই তিনি পুলিশের চক্ষুশূল হয়েছেন। আর এ কারণেই পুলিশের ঠান্ডা মাথার গুলিতে তাকে চিরতরে হারাতে হয়েছে একটি পা।

পা হারানোর পর ৯ মাস জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে সাইফুল ঘুমাতে পারছেন না পুলিশের হয়রানিতে। কিছুদিন পর পরই বায়েজিদ থানা পুলিশের টহল টিম গিয়ে হানা দেয় তার বাড়িতে। এমনকি মধ্যরাতে গিয়েও পুলিশ ভাঙচুর করেছে তার বাড়িতে।

২০২১ সালের ১৬ জুন জনসম্মুখ থেকে ধরে নিয়ে সাইফুলকে পায়ে গুলি করে ফেলে রাখা হয় চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায়। ঘটনার পরদিন পুলিশ জানায়, সাইফুল পুলিশের ওপর গুলি করে, আর পুলিশও পাল্টা গুলি করলে সেই গুলি লাগে তার হাঁটুতে। আর এতেই তার একটি পা হারাতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, সাইফুলের একটি পা নিয়েও শান্ত হয়নি বায়েজিদ থানার পুলিশ।

২০২১ সালের ১৬ জুন। রাত তখন ৮টা। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বের হলে সাইফুলকে ফোন দেন বায়েজিদ থানার সোর্স আকাশ। ফোনের ওপাশ থেকে সোর্স আকাশ জানান, একটি মামলার বিষয়ে জরুরি কথা আছে, দেখা করতে হবে এখনই।

সোর্স আকাশের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা  খাওয়ার জন্য জামান হোটেলে যান। খাবার অর্ডারের পর মামলার বিষয়ে কথা শুরু করেন। অর্ধেক খাওয়ার পর সাইফুল ও আকাশকে হঠাৎ সাদা পোশাকে এসে ঘিরে ধরেন বায়েজিদ থানার সদ্য বিদায়ী ওসি কামরুজ্জামান, এসআই মেহের অসীম দাশ, এসআই তানভীর, রবিউল, সাইফুলসহ আরও তিন পুলিশ সদস্য। তাদের সবাই মাস্ক পরা ছিলেন।

এ সময় ওসি কামরুজ্জামান টেবিলের ওপরে থাকা আমার মোবাইল ও বাইকের চাবি নিয়ে পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন—একদম চুপ, কোনও কথা বলবি না। এরপর একজন আমাকে মাস্ক পরিয়ে হোটেলের সামনে থাকা একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারের ভেতর ঢুকিয়ে চোখেমুখে গামছা দিয়ে এবং হাতে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেন তারা।’

সাইফুল বলেন, ‘রাত ৯টার পর থেকে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার পর রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় বায়েজিদ লিংক রোডে। চোখ গামছা দিয়ে বন্ধ থাকলেও গামছার নিচ দিয়ে রাস্তাটি দেখে চিনে ফেলি। আমাকে একা রেখে গাড়ি থেকে সবাই নিচে নেমে যায়।

এর কিছুক্ষণ পর আমার চোখের গামছা খুলে এসআই অসীম এসে বলে—সাইফুল, টাকা দে ৫ লাখ, ওপর থেকে অর্ডার আসছে, শেষ করে দেবো তোরে, কালেমা পড়।’ তখন আমি বলি, পসিবল না স্যার, আরেকটু কমাই-সমাই বলেন। তখন অসীম ‘যাহ্ ব্যাটা’ বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়।

ওসি কামরুজ্জামান ফোন করে অপর প্রান্তে থাকা কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ‘তোমরা ড্রেস পরে জামানে যাও, তারপর রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত হোটেলের সব সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করে দাও। আর বলবা ওপরের নির্দেশ আছে।’ওই রাতের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া না গেলেও সেদিনের ঘটনার একটি ছবি নিজের মুঠোফোনে ধারণ করেন সাইফুলের এক পরিচিত লোক। ছবিতে সাদা পোশাকে মাস্ক পরা একাধিক পুলিশকে জামান হোটেলের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

আমাকে যখন কার থেকে নামানো হলো তখন লিংক রোডের দু’পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েকজন পুলিশ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। তখন ওসি কামরুজ্জামান আমার বাম পায়ে একটা শ্যুট করেছে। একদম হাঁটুতে, নিচে, শর্টগান দিয়ে।

এর এক মিনিট পর অসীম দাশ দৌড়ে এসে ওসির হাত থেকে শর্টগান নিয়ে আরও একটা শ্যুট করেছে। এরপর আর কিছু জানি না আমি, অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান আসে তখন দেখি, আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলের বেডে শুয়ে আছি। ডাক্তাররা আমাকে স্যালাইন দিচ্ছে’—যোগ করেন সাইফুল।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তার বলে, আমার পা বাঁচাতে চাইলে আমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত। পরে আমার পরিবার আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে ওসি বলে, ‘ওরে ঢাকা নেওয়া যাবে না। সে সন্ত্রাসী, তারে আমরা স্কট (পুলিশি পাহারা) দিতে পারবো না’। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কী মনে করে ওসি আবার বলতেছে, ‘ঠিক আছে, নিয়ে যান, আমরা স্কট দিয়ে ওরে ঢাকায় পাঠাব।’

সব থেকে কষ্টের বিষয় হলো, আমাকে যখন পঙ্গু হাসপাতালে নামানো হলো, তখন পুলিশগুলো আমার পরিবার থেকে চা নাস্তার খরচ নেয় ১ হাজার টাকা করে। পরে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলেছে, দেরি হয়ে গেছে, এখন পা রাখা সম্ভব না। ওকে বাঁচাতে হলে পা ফেলে দিতে হবে। যদি আর্লি আসা যেতো তাহলে পা বাঁচানো যেতো। সেখানেই সেদিন অপারেশন করে আমার পা কেটে ফেলা হয়। ১৬ দিন ঢাকায় চিকিৎসার পর আমাকে চট্টগ্রামের জেলে ঢোকানো হয়।’

অবশ্য সাইফুলের এই বিবরণ ‘মিথ্যা’ দাবি করে বায়েজিদ থানার এসআই মেহের অসীম দাশ বলেন, ‘আমি যেহেতু সাইফুলের মামলার আইও, তাই আমি মামলাগুলো তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিই। রিপোর্টগুলো ওর বিরুদ্ধে যাওয়াতে সে রাগ-ক্ষোভ থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।’

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button