এক্সক্লুসিভএশিয়াকূটনীতিজাতীয়বান্দরবানবাংলাদেশ

বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে মিয়ানমার, প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা মানছে না

বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে মিয়ানমার। দেশটি সীমান্ত লঙ্ঘন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা মানছে না। বরং বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রতিদিনই আকাশে উড়ছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার।

বাংকার থেকে ছোড়া গোলার বিকট শব্দে কাঁপছে এপারে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, বাইশাফাঁড়ি, রেজু গর্জনবনিয়া, আমতলিসহ পুরো সীমান্ত এলাকা। মাঝে মাঝেই মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা, মর্টার শেল এসে পড়ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ আশ্রয় নেওয়া সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া গোলা বারবার বাংলাদেশে এসে পড়ায় এবং একজনের মৃত্যুর ঘটনায় আবারও দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতকে তলবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার ‘উইং’ তাকে তলব করেছে। এ ছাড়া আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও সীমান্ত লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোচনায় তুলবে বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তিন দফা তলব করে প্রতিবাদ জানানো হলেও থামেনি তাদের আগ্রাসী তৎপরতা। এবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে এক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এতে এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলেরও আশঙ্কা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো ধরনের উসকানিতে পা না দিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে এগোতে হবে। প্রতিবেশী ভারত ছাড়া কেবল মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলসীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। সেই সীমান্তে থেমে থেমে নানা উত্তেজনা বহু বছর ধরে চলে আসছে।

২০০৭ সালে সেন্টমার্টিনে ঢুকে পড়েছিল মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধজাহাজ। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে অস্ত্রসহ বিজিবি সদস্যকে অপহরণ করে তারা। বান্দরবানের থানচিতে মর্টার শেল ও গুলি পড়ে ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। ২০১৪ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বিজিবি সদস্যকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায় মিয়ানমার।

২০১৯ ও ২০২০ সালে সেন্টমার্টিনকে নিজেদের অংশ দেখায় দেশটি। এ ছাড়া ২০১৭ সালের পর থেকে ১৯ বারেরও বেশি মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। আর গত এক মাসে বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের ছোডা মর্টার শেল ও গোলাবারুদ পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

সর্বশেষ শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫টি মর্টার শেল পড়ে। গত ৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকালে মিয়ানমার থেকে ছোড়া আরও একটি গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে। সেটি ছিল তৃতীয় দফায় আসা গোলা।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডেও তুমব্রু ঘোনারপাড়া নামক এলাকায় এটি পড়ে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর আগে গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত দুটি মর্টার শেলের গোলা একই ইউনিয়নের তুমব্রু উত্তরপাড়া জামে মসজিদ এলাকায় পড়ে।

সেগুলো বিস্ফোরিত না হওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরে ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় যুদ্ধবিমান থেকে ফায়ার করা দুটি গোলা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি এলাকায় পড়ে।

ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা। ২০১৭ সালের মতো ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেবে না বাংলাদেশ, এমন স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। নেপিদোর বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকার উদ্বেগের বিষয়টি জোরালোভাবে জানানো হয়েছে। ঢাকায় বিদেশি মিশনগুলোকেও জানানো হয়েছে যে, একজন রোহিঙ্গাকেও আর বাংলাদেশ নেবে না। বরং যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে নজর ঢাকার, সে বার্তাও দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদে বলেন, ‘সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছে। সেটা তাদের অভ্যন্তরে থাকলে এক কথা। কিন্তু কিছু গোলাবারুদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ছে।

এখন তো আহত হয়েছে, রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এটাকে আমরা উসকানি হিসেবে ধরব। সেটা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ভিতর গোলা এসে পড়তে পারে না। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আনা উচিত। সেটা জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন হতে পারে। পাশাপাশি সামরিক-কূটনীতিও তৎপরতাও চালু করা যেতে পারে।’

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লুইস গুয়েন। গতকাল সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতি রাখাইন থেকে উদ্বিগ্নের। জাতিসংঘ প্রতিনিয়তি পর্যবেক্ষণ করছে, মিয়ানমারের মিশনের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সত্যি বলতে পুরো ঘটনা স্পষ্ট নয়। যদিও ঘটনাস্থলে দেখবার অনুমতি নেই। তাই উভয় দেশকে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ করেন লুইস গুয়েন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুুল মোমেন বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান চাই। তাদের সীমান্তে আরাকান আর্মি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। তারা ঘটনা ইচ্ছাকৃত নয় বলে দাবি করেছে। এরপরও আমরা আমাদের সীমান্ত সিল করেছি।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না; আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান চায়।’ সীমান্ত পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমানায় এসে যে গোলাবারুদ পড়ছে, এটার কড়া ভাষায় আমরা প্রতিবাদ করছি। ওদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছি।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী কখনই যুদ্ধ চান না, আমরা চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান। তাদের যে ইন্টারনাল কনফ্লিক্ট (অভ্যন্তরীণ সংঘাত), সেটা তাদের সীমানার ভেতরেই থাকুক। বাইরে যেটা আসছে, সেটার সব সময় প্রতিবাদ করে আসছি। শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

আমাদের পক্ষ থেকে না হয় জাতিসংঘের কাছে তুলব। আমরা সবকিছু করব।’ বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় মিয়ানমারের কথা দিয়ে কথা না রাখার বিষয়ও উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার কোনো সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সব চেষ্টাই করে যাচ্ছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button