অর্থ ও বাণিজ্যউদ্যোক্তাবাংলাদেশবিদ্যুৎ ও জ্বালানী

দেশে গ্যাসের সংকট প্রকট, শিল্প কারখানায় অশনি সংকেত

দেশে প্রকৃত গ্যাসের চাহিদা কত, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। পেট্রোবাংলা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, শিল্পমালিকরা প্রতিদিন গ্যাসের সংযোগ বা কারখানার গ্যাসের লোড বাড়াতে যে পরিমাণ দৌড়ঝাঁপ করেন, তাতে পাঁচ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করলেও সেটা ব্যবহার হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটামোটি চার হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস প্রতিদিন সরবরাহ করতে পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা বা আবাসিক গ্রাহকরা সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে ২৭০০ এমএমসিএফডি। এ বিশাল ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার চরম হিমশিম খাচ্ছে।

দেশে গ্যাসের সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। গ্যাসের সংকটে শিল্পকারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে, যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। একই অবস্থা আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও। তারাও নিয়মিত গ্যাস পাচ্ছেন না। দিনের নির্দিষ্ট সময় কিংবা গভীর রাত ছাড়া গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ থাকছে না।

শিল্পকারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় সংকট বাড়তে পারে। বেকার হতে পারেন অনেক শ্রমিক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। নইলে বিপর্যস্ত হবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা।গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকেও শিল্পকারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গ্যাসের যে কি ভয়াবহ সংকট, সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, এ অবস্থা বেশি দিন চললে কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। এখন এলপিজি দিয়ে কারখানা কোনো রকম চালু রাখার চেষ্টা করছি। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, কিন্তু কোনোভাবেই গ্যাসের চাপ বাড়াতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে চললে আমরা বিদেশিদের ক্রয়াদেশ ঠিকঠাক মেটাতে পারব না। তেমনটা ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই কারখানার কোনো ভবিষৎ নেই।’ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটা শুধু আমার একার অবস্থা নয়, আমি মনে করি সব শিল্পমালিকের একই অবস্থা।’ নারায়ণগঞ্জের ডায়িং কারখানার এক মালিক বলেন, ‘গ্যাসের অভাবে গত সপ্তাহে প্রায় ৫ দিন টানা তার কারখান বন্ধ ছিল।’

নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি মাসের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট প্রকট হতে থাকে, যা এখনো কাটেনি। গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কখনো কখনো গ্যাসের চাপ বাড়লে শিল্পকারখানা চলে, আবার মাঝে মধ্যে বন্ধ রাখতে হয়।

গ্যাসের সংকট নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট চলছে। সেই প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’

গ্যাস সংকটের বিষয়ে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ক্যানসার আক্রান্ত হলে যেমন মানুষ ধীরে ধীরে মরে যায়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের শিল্পকারখানা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গ্যাসের সংকটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

অনেক নিট কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে এখন আমাদের কাপড় কিনতে হচ্ছে চীন থেকে।’মো. হাতেম বলেন, ‘সরকার যদি রিজার্ভ থেকে এলএনজি আমদানি করে আমাদের সরবরাহ করত, তবে আমরা আগামী ছয় মাসে তার অনেক বেশি রিজার্ভ রিটার্ন দিতে পারতাম।’

পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, গতকাল সারাদিন পেট্রোবাংলা ২৭৮৯ এমএমসিএফডি গ্যাসের সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে এলএনজি ছিল ৪৮১ এমএমসিএফডি। বাকিটা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলিত। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছে, অনেক বেশি দাম হওয়ায় একদিকে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি কমছে, অন্যদিকে দেশীয় কূপগুলো থেকেও গ্যাসের জোগান কমছে। ফলে সংকট তীব্র হচ্ছে।

২০১৫ সালের দিকেও দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুট। সেটা কমে এখন ২৩০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করে আসছিল। এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ফলে গ্যাসের সংকট বাড়তে থাকে।

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button