আওয়ামী লীগএক্সক্লুসিভছাত্রলীগঢাকাবাংলাদেশরাজধানীরাজনীতিশিক্ষাঙ্গন

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের পদ পেয়েই শুরু হয় তাদের বেপরোয়া জীবন

ইডেন কলেজে টানা তিন বছর ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। চলতি বছরের মে’তে তামান্না জেসমিন রিভাকে সভাপতি এবং রাজিয়া সুলতানাকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। পদ পেয়েই শুরু হয় তাদের বেপরোয়া জীবন।

অনেকটা মগের মুল্লুকে পরিণত করেন দেশের  ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ হোস্টেলকে। কলেজ এবং হোস্টেল পরিচালনায় প্রশাসন থাকলেও সবকিছু চলতো এই দুই নেত্রীর অঙ্গুলি হেলনে। সিট বাণিজ্য, চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়েছেন তারা।

সাম্প্রতিক ঘটনার পর তাদের নিয়ে আরও ভয়াবহ এবং জঘন্য তথ্য বের হয়েছে নানা মাধ্যমে। খোদ নিজ সংগঠনের বিদ্রোহী নেত্রীরাই তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, ইডেনের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি এই দুই নেত্রী। কথিত নেতাদের তুষ্ট করতে তাদের চাহিদা মতো শিক্ষার্থীদের নানা জায়গায় পাঠাতেন এই নেত্রীরা। এমন তথ্য প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

মাসখানেক আগে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাতে এই ছাত্রলীগ নেত্রীকে কোনো এক সাধারণ শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোনো বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?

প্রায় সমসাময়িক বের হওয়া আরেকটি অডিও রেকর্ডে রিভা অনেকটা দম্ভ করেই বলেন, ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের উপরে আর কেউ নাই। শুধু কথায় না কাজেও তাই প্রমাণ করেছেন রিভা।  হলে কে থাকবে, না থাকবে, আবাসিক শিক্ষার্থীরা মাসিক কিংবা বাৎসরিক কতো টাকা ‘সিটভাড়া’ দিবে, ক্যান্টিনগুলো কীভাবে চলবে কিংবা কতো টাকা চাঁদা দিবে, ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সেবা কারা দিবে, ইডেনের আশেপাশে ফুটপাথ দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে ব্যবসার অনুমতি- সবই পরিচালিত হতো ছাত্রলীগ নেত্রীদের আঙ্গুলের ইশারায়।

প্রশাসনিক কার্যক্রমে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ছিল একেবারেই সীমিত। হল প্রভোস্ট থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত কেউই ছাত্রলীগ নেত্রীদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করেননি।

এসব দেখে ঘৃণা আর ধিক্কার জানাচ্ছে মানুষ। প্রশ্ন হলো- এই দুই নেত্রী কাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের এমন বেপরোয়া করে তুলেছেন। তাদের কাছ থেকে কারা এমন সুবিধা নিয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

সাম্প্রতিক নানা ঘটনা, কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত, বিক্ষোভের মুখে হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর এই দুই নেত্রী আবার বীরদর্পে হলে ফিরে এসেছেন। এরপর থেকে এখন আবার পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। আতঙ্ক ভর করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে।

এখন প্রশ্ন হলো এত কিছুর পরও কেন এই দুই জনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এত অভিযোগ থাকার পরও কেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতারা ওই দুই জনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। একাধিক সূত্রের দাবি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি আরও অনেকে ইডেন নেত্রীদের আশীর্বাদ দিয়ে আসছেন। এ জন্য তারা এতটা বেপরোয়া। তারা  কোনো কিছুই পরোয়া করছেন না। অবলীলায় একটি সরকারি কলেজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ক্ষমতাশালীদের ছায়ায় থাকায় কলেজ প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার সাহস পাচ্ছে না।

পদ পাওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম হতে থাকেন রিভা ও রাজিয়া। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার অপরাধে দুই শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ উঠে সভাপতি রিভার বিরুদ্ধে।

দিয়েছিলেন হল ছাড়া করার হুমকিও সেই ঘটনায় চারদিক থেকে ক্রমাগত ধেয়ে আসা সমালোচনার মুখে  ক্ষমা চেয়েছিলেন রিভা। তবে সেটি যে একেবারেই লোক দেখানো ছিল, তা প্রমাণ করতে বেশি সময় নেননি এ প্রভাবশালী নেত্রী।  ক্যাম্পাসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিণী যে তিনি নিজেই সেটি প্রমাণ করতে রিভা দু’দিন পরেই নির্যাতনের অডিও ও তথ্য সংবাদ মাধ্যমে দেয়ার অভিযোগে দুই শিক্ষার্থীকে একটি কক্ষে আটকে  রেখে টানা ৬ ঘণ্টা নির্যাতন করেন।

ওই সময় সে দুই শিক্ষার্থীকে হেনস্তার পাশাপাশি বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকিও দেন। এরপর প্রশাসনের সহায়তায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনার ‘অপরাধে’ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইডেন পড়ুয়া এমন এক সাধারণ শিক্ষার্থী বলেন, ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজে বর্তমান ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজারের মতো। এর বেশির ভাগেরই রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা শুধু পড়াশোনা করতেই এই কলেজে ভর্তি হয়েছি। মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর অপকর্মের কারণে যেভাবে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে তাতে আমাদের সম্মানহানি হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের কাছে কলেজ সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে।   যে কারণে রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, তদন্তের নির্দেশ রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক মোছা. রাজিয়া সুলতানাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নির্যাতিত ছাত্রলীগ নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী।

গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোস্তফা রেজা নুরের আদালতে এ মামলা করেন তিনি। মামলার আবেদনের শুনানি শেষে লালবাগ থানাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আগামী ২৪শে অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলায় ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদক ছাড়াও নুঝাত ফারিয়া রোকসানা, মিস ইসলাম, নূরজাহান, ঋতু আক্তার, আনিকা তাবাসুম স্বর্ণা ও কামরুন নাহার জ্যোতিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২৫/৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

সিট বাণিজ্য ফুটপাথ থেকে প্রাপ্ত চাঁদাবাজির টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ শীর্ষ নেত্রীদের মনোমালিন্যের কথাও প্রকাশ্যে আসে। সম্প্রতি ইডেনে ছাত্রলীগ কমিটির একটি অংশ আন্দোলনে নামলে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে আরও ভয়াবহ সব অভিযোগ বেরিয়ে আসতে থাকে।

চাঁদাবাজি, আসন বাণিজ্যের পাশাপাশি রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের দিয়ে জোর করে অনৈতিক কাজ করানোর অভিযোগ তুলেন বিদ্রোহী নেত্রীরা। মূলত গত ২৪শে সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিয়োগ বাণিজ্য ও নানা অপকর্মের বিষয়ে সাংবাদিকদের তথ্য দেয়ার অভিযোগে জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে হেনস্তা ও মারধরের ঘটনার পর থেকেই বিদ্রোহের সূত্রপাত।

দুই নেত্রীর নির্দেশে সেদিন রাতে কমিটির সহ-সভাপতি পদমর্যাদার এই নেত্রীকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ক্যাম্পাসেও। আর এর বিরুদ্ধে  সেদিন রাত থেকে আন্দোলনে নামে ছাত্রলীগের একাংশ। পরদিন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির বিভিন্ন পদধারী ২৫ নেত্রী একত্রিত হয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।

ইডেনে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও প্রশাসন বিস্ময়করভাবে পুরোটা সময় জুড়ে ছিল নীরব। দু’পক্ষের মধ্যে সমস্যা নিরসনে কিংবা সংঘর্ষ এড়াতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন সংঘর্ষ হয়েছে কিংবা সংঘর্ষে কারা জড়িত এই ব্যাপারেও প্রশাসনকে কোনো অবস্থান কিংবা কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়নি।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্য ইডেন কলেজের প্রশাসন আছে নামেমাত্র, ছাত্রলীগ নেত্রীদের ইচ্ছের বাইরে তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই।  এদিকে ছাত্রলীগে দু’গ্রুপের অন্তকোন্দলে সবচেয়ে বড় ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্যাম্পাসের হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থী। গণমাধ্যমে প্রচারিত নানা ধরনের ‘রসালো’ সংবাদে সামাজিকভাবে তারা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button