এক্সক্লুসিভজাতীয়জামায়াত ইসলামীনির্বাচনবাংলাদেশবিএনপিরাজনীতি

রাজনীতিতে বিএনপি জামায়াতের দূরত্ব বাড়ছে

হাজারীবাগের সমাবেশে গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর দেওয়া বক্তব্য এবং পরদিন মঙ্গলবার জামায়াতের কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া নিয়ে উভয় দলের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্বস্তি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় উভয় দলের মধ্যে দূরত্ব কোন পর্যায়ে আছে?

এ প্রসঙ্গে জামায়াত নেতারা বলেন, ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরীক বিএনপি ও জামায়াত। সম্প্রতি, যুগপৎ আন্দোলনের ভাবনা থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে একে অপর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। কিন্তু, হঠাৎ করে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর এ বক্তব্যে জামায়াত ও বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা যেতে পারে।

প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চললেও বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে জামায়াতের। এ দূরত্ব এতদিন খুব একটা প্রকাশ না পেলেও এখন অনেকটাই দৃশ্যমান।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সেই দূরত্ব বেড়েছে কয়েক গুণ, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক এখনও তলানিতে। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আসন বণ্টন ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উপর বিএনপির অতিমাত্রায় নির্ভরতার বিষয়টি মানতে পারছে জামায়াত। এর বহির্প্রকাশ ঘটেছে দলটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে।

জামায়াত নেতারা বলেন, যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার শুধু জামায়াত নয়, বিএনপিসহ বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না, প্রতিদিনই বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, মামলা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, গুলি করে তো বিএনপিরই চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। জামায়াতের প্রশ্ন—বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ কার কথায় এমন বক্তব্য দিয়েছেন?

তাঁরা আরও বলেন, দীর্ঘদিন থেকে জামায়াত ও বিএনপি জোটবদ্ধভাবে পথ চলছে। এ অবস্থায় বিএনপির ইতিবাচক বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জামায়াতের চেয়ে ভালো কেউ-ই জানে না—এটাই তো স্বাভাবিক। এখন যদি জামায়াত নেতারা বিএনপির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৯৯৭-৯৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে মধুর। জামায়াতকে রাজনীতিতে শক্ত জায়গা করে দেয়ার জন্য বিএনপিকে কম কথা শুনতে হয়নি। বিশেষ করে ২০০১ সালে জামায়াতের দুই নেতাকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়ায় বিএনপিকে এখনও অনেকে সহ্য করতে পারছে না।

জামায়াতও বিএনপির সেই আস্থার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করেছে প্রতি পদে পদে। বিশেষ করে ২০০৫ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে থেকে বিএনপিকে সর্বোচ্চ সহায়তা করে জামায়াত।শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়টাতে একতরফা ভোট ঠেকাতে জামায়াত ছিল বিএনপির রাজপথের সঙ্গী। সারা দেশে আন্দোলন সংগঠিত করতে কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেছে ধর্মভিত্তিক এ দলটিই।

এদিকে, বেশ আগে থেকেই বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী নেতা হিসেবে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর পরিচিতি আছে। তিনি দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠকগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে জামায়াত ছাড়ার পক্ষে জোরালোভাবে তার যুক্তি তুলে ধরে মতামত দিয়েছেন।

কয়েক মাস আগে যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা চলছিল। সেখানে এক নেতা তার মতামত দিতে গিয়ে বলেন, আসলে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আছে কিনা, আগে সেটা খোঁজ নিতে হবে। তাদের সন্দেহ—জামায়াত তার নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।

যদিও জামায়াত নেতাদের দাবি, তাদের পক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক করা রাজনৈতিক কারণেই সম্ভব নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচার শেষে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক করা হলে তৃণমূলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে নেতাদের।

বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলসহ হাতে গোনা কয়েকজন নেতা এ মুহূর্তে কারাগারে রয়েছেন। আমিরসহ বাকিরা তো তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড করছেন। যেখানে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও পুলিশ গ্রেপ্তার করে, সেখানে জামায়াতের আমিরসহ তাদের অনেকেই তাদের দলীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন।

এ নিয়ে জামায়াতের মধ্যেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা চলছে। তবে, জামায়াত নিয়ে নানা সন্দেহ থাকলেও স্থায়ী কমিটির সদস্য টুকুর প্রকাশ্যে জামায়াত নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। আগামী দিনে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে প্রভাব পড়তে পারে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে । যখন আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক দণ্ড- এমনকি ফাঁসি দিতে থাকে, তখন বিএনপিকে পাশে পায়নি জামায়াত। এমনকি জামায়াতের ওই সব নেতার পক্ষে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি জোটসঙ্গী বিএনপি। এতে হতাশ ও চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে জামায়াত।

এর পর থেকে বিএনপি সরকারবিরোধী যত আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দিয়েছে, সেগুলোতে জামায়াত নৈতিক সমর্থন দিয়েই দায় এড়িয়েছে। কৌশলগত কারণে জোট থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে আগের সেই সখ্য আর দেখা যায়নি। এমনকি ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাকেও দেখা যায়নি।

বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে একাদশ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে বিএনপি আলাদা একটি মোর্চার শরিক হওয়ার পর। বিএনপি কার্যত ২০ দলকে পেছনে ফেলে নতুন জোটের নেতাদের ভ্যানগার্ড হিসেবে বেছে নেয়। ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের কেউ-ই জামায়াতকে মেনে নিতে পারেনি।

এমনকি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বিএনপির সঙ্গে জোটে আসেনি। ড. কামাল-কাদের সিদ্দিকী-আ স ম রব-মাহমুদুর রহমান মান্নারা শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোট করলেও দলটির সঙ্গে জামায়াতের গাঁটছড়া এমনকি অস্তিত্ব মেনে নেয়নি।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button