ভাসমান খাঁচা পদ্ধতিতে মাছ চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে সারা দেশে

খাঁচায় মাছচাষ প্রদ্ধতি দিনের পর দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছচাষ। নদী বা জলাশয়ে ভাসমান খাঁচায় মাছচাষ একটি আধুনিক পদ্ধতি।

ভাসমান খাঁচায় মাছচাষ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ পদ্ধতিতে মাছচাষে অনেক সুবিধা। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে খাঁচায় মাছচাষ নতুন আঙ্গিকে শুরু হলেও বিশ্ব অ্যাকুয়াকালচারে খাঁচায় মাছচাষের ইতিহাস অনেক পুরনো। খাঁচায় মাছচাষ শুরু হয় চীনের ইয়াংঝি নদীতে প্রায় ৭৫০ বছর আগে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে আধুনিককালে খাঁচায় মাছচাষ দ্রম্নত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করলে স্বল্প ব্যয়ে কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়।

দেশে বেকার শিক্ষিত তরুণ, জেলে ও মাছচাষিদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ পদ্ধতিটি। কম পুঁজিতে বেশি লাভজনক হওয়ায় ভাসমান এ পদ্ধতিতে মাছচাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। এতে বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে অনেকের।

খাঁচায় মাছচাষে রয়েছে বিশেষ সুবিধাও। দেশের নদনদী ও খাল বিল প্রধান জেলাগুলোতে, কিংবা নিজ বাড়ির পাশেই যাদের নদী-খাল রয়েছে তারা চাইলেই এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করতে পারেন। ভাসমান খাঁচায় মাছচাষ করলে পুকুরের মতো জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না। প্রবাহমান নদীর পানিকে যথাযথ ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন বাড়ানো যায়।

মাছের বর্জ্য প্রবাহমান পানির সঙ্গে অপসারিত হয় বিধায় পানি দূষিত হয় না। মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেয়ে বরং নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজাতির ওজন বৃদ্ধি পায়। প্রবাহমান থাকায় প্রতিনিয়ত খাঁচার অভ্যন্তরের পানি পরিবর্তন হতে থাকে ফলে পুকুরের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছচাষ করা যায়। পুকুরে চাষকৃত মাছের চেয়ে খাঁচায় চাষকৃত মাছ বেশি সুস্বাদু হয়ে থাকে।

চীনে খাঁচায় মাছচাষ প্রযুক্তি বেশ জনপ্রিয়। যতদূর জানা যায়, চীনেই প্রথম ছোট খাঁচায় বেশি ঘনত্বে মাছচাষ শুরু হয়েছিল। সম্পূরক খাবার দিয়ে খাঁচায় তেলাপিয়া এবং কার্প চাষ খুব জনপ্রিয়। তাইওয়ানেও খাঁচায় মাছচাষ করা হয়। সেখানে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া খাঁচায় চাষ করে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের তেলাপিয়ায় পরিণত করা হয় এবং পরে রপ্তানি করা হয়।

দেশটি বছরে ২০ লাখ টন ফ্রোজেন তেলাপিয়া এবং ১০ লাখ টন তেলাপিয়া রপ্তানি করে। ইন্দোনেশিয়ায়ও খাঁচায় মাছচাষ জনপ্রিয়, তবে জাভা অঞ্চলে এই প্রযুক্তির প্রচলন অনেক বেশি। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অতি সাধারণ জাল দিয়ে তৈরি খাঁচায় এক বছরের জন্য কোরাল বা ভেটকি মাছচাষ করা হয়। সমুদ্রে ছোট মাছ ধরে তা খাঁচায় মাছের জন্য খাবার হিসেবে দেয়া হয়। ওদিকে, ভিয়েতনামে স্রোতহীন নদীতে খাঁচায় জলজ আগাছা খাদ্য হিসেবে দিয়ে কার্প জাতীয় এবং তেলাপিয়া মাছচাষ করা হচ্ছে।

খাঁচা স্থাপনের জন্য উপযোগী, নদীর এমন অংশ যেখানে একমুখী প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার প্রবাহ রয়েছে। নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪-৮ ইঞ্চি মাত্রার পানি প্রবাহে খাঁচা স্থাপন মাছের জন্য উপযোগী, তবে প্রবাহের এ মাত্রা সর্বোচ্চ সেকেন্ডে ১৬ ইঞ্চি এর বেশি না হলেই ভালো। মূল খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য নূ্যনতম ১০ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন।

খাঁচার তলদেশ নিচের কাদা থেকে নূ্যনতম ৩ ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক। খাঁচা স্থাপনের স্থান থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হতে হবে যাতে সহজে মাছ বাজারজাত করা যায়। খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনোভাবেই নৌ চলাচলে সমস্যা না হয় এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে।

খাঁচা স্থাপনের জায়গাটি এমন হতে হবে- যাতে কলকারখানার বর্জ্য কিংবা কৃষিজমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টিতে কীটনাশক প্রভাবিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মরে না যায়। খাঁচা তৈরির জন্য এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যেন কাঁকড়া, গুইসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রাণী জালগুলো কাটতে না পারে।

ডাকাতিয়া মডেলের খাঁচার জন্য সাধারণত দুই আকারের জাল তৈরি করা হয়, যেমন- ২০ ফুট ১০ ফুট ৬ ফুট এবং ১০ ফুট ১০ ফুট ৬ ফুট। খাঁচা তৈরির জন্য জালগুলো মেস ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি থেকে ১১ থেকে ৪ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া ভালো। এতে সহজে নদীর পরিষ্কার পানি প্রতিনিয়ত খাঁচার ভেতরে সঞ্চালিত হতে পারে।

দেশে দিনে দিনে জলাশয় কমে যাচ্ছে কিন্তু জলাশয় কমে গেলেও আমাদের প্রচুর নদী ও খাল রয়েছে যেখানে সারা বছর মাছচাষ করা যায়। আর এসব জলাশয়ে মাছচাষের সহজ উপায় হচ্ছে খাঁচায় মাছচাষ করা। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ফলে দেশে খাঁচায় মাছচাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে জায়গা কম লাগে এবং অধিক লাভজনক।

খাঁচায় মাছচাষ নদী বা জলাশয়ে আধুনিক মাছচাষের একটি পদ্ধতি। ২০০২ সাল থাইল্যান্ডের অনুকরণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রথম বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে এ পদ্ধতিতে মাছচাষ শুরু হয়। তাই বাংলাদেশে এ ধরনের মাচ চাষ ডাকাতিয়া মডেল নামেও পরিচিত।

সাধারণত গভীরতা ছয় ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট ও দৈর্ঘ্য ২০ ফুট এমন খাঁচার মাছচাষ করেন অধিকাংশ চাষিরা। একটি হিসেব বলছে এমন প্রতিটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। মাছের পোনা ও খাবার কিনতে আরো ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পরে খাঁচায় পোনা ভরে তা ভাসিয়ে রাখা হয় নদীতে। ছয় মাস পর এই মাছ বড় হয়। পরে তা কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। এভাবে অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। ফলে সম্প্রতি বিভিন্ন নদনদীতে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

স্থাপিত খাঁচায় মাছের প্রজাতি ভেদে যেমন প্রতি ঘনমিটারে ৩০ থেকে ৪০টি পর্যন্ত মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুত করা যাবে। মজুতকালে পোনার আকার এমন হতে হবে- যাতে জালের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। মাছ খাঁচায় মজুতের পর থেকে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।

মাছের ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম হওয়া পর্যন্ত সম্পূরক খাদ্য প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, মজুত থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ৭৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের মাছ উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ দেড় কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।

সাধারণত প্রত্যাশিত উৎপাদনের জন্য খাঁচায় পোনা মজুদের তিন সপ্তাহ পর প্রথম বার খাঁচার মাছ বাছাই করতে হবে। দিনের তাপমাত্রার দিকে লক্ষ্য রেখে সকাল বেলা কিংবা শেষ বিকালে খাঁচার জন্য মাছ বাছাই করা উচিত। যখন নদীর পানি বেশি প্রবাহমান থাকে তখন খাঁচার পানি দ্রম্নত পরিবর্তিত হতে থাকে। এ সময় খাঁচার মাছ বাছাই করা অধিক উপযোগী। বাজারজাত করার পূর্বে প্রয়োজন অনুসারে দুই তিনবার বাছাই করতে হবে।

Exit mobile version