অপরাধকক্সবাজারবাংলাদেশ

কক্সবাজারে অপ্রতিরোধ্য মানব পাচার চক্র

বিদেশে ভালো বেতনে চাকরি বা নানা কাজের প্রলোভনে চলছে কক্সবাজারে মানব পাচার কাজ। পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও পাচার করা হচ্ছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাঠে সক্রিয় বেশ কয়েকটি চক্র। সাগরপথ ও আকাশপথ পাচারের নিরাপদ রুট হলেও শীত মৌসুমে চক্রের প্রধান টার্গেট সাগরপথ। যদিও বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতিবছর প্রাণ হারায় বহু মানুষ।

কিন্তু এসব ঘটনায় যে হারে মামলা হয় সেই হারে নিষ্পত্তি ও বিচারের ঘটনা খুবই কম।সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সাগর পথ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদম পাচার কাজে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাসহ দেড় শতাধিক স্থানীয় ও বহিরাগত দালাল। উপকূলীয় এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্যের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে দালালরা দেশের বিভিন্ন এলাকার সহজ সরল লোকজনদের মালয়েশিয়ায় সোনার হরিণ ধরার প্রলোভন দেখিয়ে উপকূলে জড়ো করে মানব পাচার অব্যাহত রেখেছে।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন মাঝে-মধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু কিছু মালয়েশিয়াগামীকে আটক করলেও রহস্য জনক কারণে মূল হোতারা থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে। এছাড়া পুলিশের হাতে আটক হওয়া মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে ছেড়ে দেওয়ায় এবং চিহ্নিত দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন না করায় মানব পাচার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলে মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে ২৮টি। যেখানে ৭১৩ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় ৬৯ জনকে। এরমধ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া পাচারকালে উদ্ধার করা হয় ২৩৯ জন রোহিঙ্গাকে। ট্রলার ডুবে নিহত হন ২১ জন, মানব পাচারের ১৬ মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৪১ জনকে।

আইন কর্মকর্তাদের দাবি, এসব মামলায় সাক্ষী পাওয়া কঠিন, তাই সহজে বিচার কাজ শেষ করাও কঠিন। তবে শুধু মামলা নয়, দালাল নিয়ন্ত্রণ ও মানব পাচার রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা বলছেন তারা।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে ৬৩৭টি মামলা হলেও তার একটিরও বিচারকার্য শেষ হয়নি। মামলাগুলোর কিছু কিছু চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হলেও সাক্ষী নিয়ে জটিলতা থাকায় এসব মামলা আলোরমুখ দেখছে না। তবুও রাষ্ট্রপক্ষ চেষ্টা চালাচ্ছে এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে।

অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অরুপ বড়ুয়া বলেন ‘কোন সাক্ষী বিজ্ঞ আদালতে এসে সাক্ষ্য প্রদান করছে না। যার কারণে বিজ্ঞ আদালত সেই মানব পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারছে না।’কক্সবাজার জেলা জজ আদালত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মামলার বিচার না হওয়ার পাশাপাশি মানবপাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া নানা উদ্যোগও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে আবারও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে দালালচক্র।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বার্তা বলেন, ‘যখন দুর্ঘটনা হয় বা মানুষ ডুবে মারা যায় তখন আমরা তৎপর হয়ে যাই। কক্সবাজারে এখন পর্যন্ত ৬৩৭টি মামলা হলেও বিচার হয়নি একটিরও। মানব পাচার আইনে দায়ের হওয়া মামলার বিচার না হওয়ায় ক্রমাগত বাড়ছে পাচারের ঘটনা।’

ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দৌজা নয়ন বলেন, ‘মানব পাচার বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে উখিয়া-টেকনাফের প্রত্যেক ক্যাম্পের ইনচার্জের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন নেতা, মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে মানব পাচার বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন , ‘মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত দালালচক্র শনাক্ত হয়েছে। এখন তাদের আটকের চেষ্টা চলছে। বিকাশের মাধ্যমে মানব পাচারের টাকা লেনদেনকারীও শনাক্ত করেছে পুলিশ। অচিরেই এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

উল্লেখ্য, গত ১১ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ১৩৮ যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে ২১ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় ৭৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ দালালকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করে কোস্টগার্ড। মামলায় এ পর্যন্ত নয়জনকে আটক করে পুলিশ।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button