অর্থ ও বাণিজ্যএক্সক্লুসিভবাংলাদেশ

শহরের বিপণিবিতানগুলোতে কমে যাচ্ছে বেচাকেনা

নিত্যপণ্যের চড়া দামের সঙ্গে বাড়ছে জীবন ধারণের অন্যসব ব্যয়। এই ব্যয় সামলাতে হিমশিম অবস্থা সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো খরচের হিসাব মেলাতে পারছে না। ফলে একে একে  নানা ব্যয় কমিয়ে সামলাতে হচ্ছে পরিস্থিতি।

এ অবস্থায় চাপে পড়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও। ব্যয়ে কাটছাঁট করছেন তারাও। এ কারণে শহরের বিপণিবিতানগুলোতে কমে যাচ্ছে বেচাকেনা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল পরিস্থিতি। এখন আবার তা বদলে যাচ্ছে। বেচাকেনা কমে গেছে আগের চেয়ে।তাই ব্যবসার খরচ পুষিয়ে জীবনধারণ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, মানুষ মার্কেটে আসা কমিয়ে দিয়েছে। বিক্রির পরিমাণ কমেছে। আগে যেখানে দৈনিক প্রায় ২৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতাম এখন সেটা কমে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কিন্তু  পোশাকের দাম বেড়েছে। দাম বাড়লে বিক্রি কমে যায়। আর বিক্রি কমলে আমাদের লাভও কমে যায়।

চলতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লস হবে বলেও জানান এক ব্যবসায়ী। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে সামনে শীত ও রোজার মাসে এটি পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, আমরা নিজেদের তৈরি পোশাক বিক্রি করি। ইদানীং বিদ্যুতের সমস্যার কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। এখানেও লস হচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো না।

মিরপুর শপিং সেন্টারের আঁখি বিতানের প্রোপ্রাইটর মো. মাহাবুব আলম সবুজ বলেন, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। এখন পর্যন্ত একটি পণ্যও বিক্রি হয়নি। মার্কেটে ক্রেতা কম। আগে দৈনিক যেখানে ৬০ হাজার টাকারও বেশি বিক্রি হতো এখন সেটি ২০ হাজারে নেমেছে। ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় হয়তো এমনটা হয়েছে। এ ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জিনিসের দাম কিছুটা বেড়েছে। এটির কারণেও হয়তো বিক্রি কমেছে। যদিও আমরা সীমিত দামে পণ্য বিক্রি করছি। তিনি বলেন, দোকানে দৈনিক ৭ হাজার টাকা খরচ আছে। সেটি এখন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেই টাকাটা উঠাতে পারছি না।

ক্রেতারাও বলছেন, অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ শপিং মলে যাচ্ছেন না।  মিরপুরের শাহ্‌ আলী প্লাজার চন্দ্রবিন্দু’র প্রোপ্রাইটার সোহান আহমেদ ইকবাল। ২০ বছর ধরে যুক্ত কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভালোভাবেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এর পর থেকে ক্রমেই তার ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। করোনার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তবে সরকার থেকে দুর্ভিক্ষের আভাস দেয়ার পর থেকে খারাপের মাত্রা চরমে পৌঁছেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার খারাপ অবস্থাকেও আগে ভালো বলেছিল। কিন্তু এখন তারাই বলছে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এতে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

টাইম শিডিউলের কারণেও ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাত ৮টার আগে দোকান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সময় যদি আরও বাড়ানো হতো তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো।  মিরপুরের শপিং সেন্টারের প্যারিস স্যুজের কর্মচারী শরীফ বলেন, ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই নাজুক। মানুষ আগের মতো দোকানে আসে না। দুই-একজন যারা আসেন, দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তারাও কিনতে চাই না। অনেক বার্গেনিং করে। কেনা দামের চেয়েও কম বলে।

তিনি বলেন, আগে যেখানে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকার জুতা বিক্রি করতাম এখন সেখানে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকার জুতাও বিক্রি করতে পারছি না। তিনি বলেন, দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ সবকিছু মিলিয়ে প্রতি মাসে দোকানের পেছনে ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়।

সবকিছু খরচ করে মহাজনের দেয়ার মতো কিছু থাকে না। আমরা নিজেরাই বিষয়টি জানি। এ জন্য বেতন বাড়ানোর কথাও বলতে পারি না। গত ৪ বছরে আমাদের কোনো বেতন বাড়েনি। ৪ বছর ধরে ১৩ হাজার টাকা বেতনেই কাজ করছি। এই বেতন দিয়ে এখন সংসার চালাতে পারি না। কম্পিউটারের কাজ কিছুটা জানি। সেখান থেকে বাড়তি কিছু আয় করে সংসার চালাচ্ছি।

শাহ্‌ আলী প্লাজার কোয়ালিটি ফ্যাশনের শাহরিয়ার ইসলাম জয় বলেন, মানুষ মার্কেটে সেভাবে আসছে না। বিক্রি কমে অর্ধেকে নেমেছে। সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। গত ৬ মাস আগে থেকে সমস্যাটি প্রকট হয়েছে।

ইস্টার্ন প্লাজায় ৩/৪১-৪২ নম্বর দোকানে শুরু থেকেই ব্যবসা করছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। বর্তমানে ব্যবসার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, সাধারণ জনগণের পকেটে টাকা নেই। বেচাকেনা হচ্ছে না। তাহলে মালিক  কোথা থেকে বেতন দেবে? এই মার্কেটে আগে কাস্টমারের লাইন লাগতো। এখন ডাক দিয়েও একটা কাস্টমার আনা যায় না।

এখানে একসঙ্গে দুইটা দোকান। দোকান ভাড়া ৪০ হাজার টাকা। সার্ভিস চার্জ আছে সর্বনিম্ন ২৪ হাজার টাকা। এই হলো ৬৪ হাজার টাকা। স্টাফ বেতনসহ অতিরিক্ত খরচা আছে? তিনি বলেন, বিক্রি হলেও দুই থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। তাহলে কীভাবে হবে? মালিক লোকসান করে নিজস্ব ফান্ড থেকে বেতন দিচ্ছে। তারা আর কতোদিন চালাবে?

মার্কেটের কতোগুলো দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো খুলেনি। মার্কেটের লেভেল ৪ এর ৫৩ নাম্বার দোকানে অবস্থিত সাগর জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী খায়রুল ইসলাম বাবু বলেন, স্বর্ণের ব্যবসায় এখন অনেক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এখন অল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের ব্যবসা নাই বললেই চলে। বিশেষ করে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের মাসিক খরচ ওঠাতে খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের এই দোকান ১৯৯৪ সাল থেকে, প্রায় ২৮ থেকে ৩০ বছর বয়স। তাও আমরা সেই অনুযায়ী উঠতে পারিনি। সঠিক স্বর্ণ আমাদেরও ক্রয় করতে হয়, সরকারকে ভ্যাট দিয়ে বেচাকেনা করতে হয়।

ফার্মভিউ মার্কেটের মিতালি শাড়ি ঘরের বিক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, ব্যবসার অবস্থা আগে খুব ভালো ছিল কিন্তু বর্তমানে ভালো নেই। ৩৮ বছর ব্যবসার বয়সে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কখনো হয়নি। তিন ভাগ বিক্রি কমেছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষও অসহায়। মানুষের হাতে টাকা নেই। আগে একটা জমজমাট অবস্থা ছিল। ক্রেতাদের মুখে হাসি ছিল। এখন একদম প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছু কিনছে না। মানুষের ইনকাম অনুযায়ী আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছে না।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button