এক্সক্লুসিভএশিয়াবিশ্ব সংবাদ

আফগানিস্তানে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গত বছরের আগস্টে তাদের সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তালেবান। তারা ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ এর পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তান থেকে নিজেদের মিশন গুঁটিয়ে নেয়।

দেশটিতে বন্ধ হয়ে যায় বিদেশি সহায়তার বেশির ভাগও। এ অবস্থায় লাখ লাখ আফগান দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।আফগানিস্তানে অনেক বাসিন্দা তাঁদের ক্ষুধার্ত শিশুদের শান্ত রাখতে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। আবার অনেকে বাঁচার তাগিদে কিডনির মতো নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা কন্যাসন্তানদের বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে পড়া এ আফগানবাসীদের একজন আবদুল ওয়াহাব। বিবিসিকে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি, ‘আমার বাচ্চারা ক্ষুধায় অনবরত কান্নাকাটি করে। ওরা ঘুমাতে চায় না। আমার ঘরে কোনো খাবার নেই।’ আরও বলেন, ‘তাই, আমি ফার্মেসিতে যাই, ট্যাবলেট কিনি এবং ওদের খাওয়াই; যাতে ওরা একটু ঘুমায়।’

আবদুল ওয়াহাব আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাতের কাছে থাকেন। তিনি ঘিঞ্জিময় এমন এক বসতিতে থাকেন; যেখানে হাজার হাজার মাটির খুপরি ঘর। দশকের পর দশক ধরে এগুলো গড়ে উঠেছে। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষ।

বিবিসির প্রতিনিধিরা ওই বসতিতে গেলে বেশ কয়েকজন তাঁদের ঘিরে জড়ো হন। তাঁদের মধ্যে কতজন সন্তানদের শান্ত রাখতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান—জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের অনেকে, আমরা সবাই।’

গত বছরের আগস্টে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন এ সরকারকে কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আফগানিস্তানে বৈদেশিক সহায়তা প্রবাহও। এ পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ দিন ওই সব মানুষের কোনো কাজ জুটছে না। খুব কম দিনই আছে, যেদিন কাজ খুঁজে পান তাঁরা আর উপার্জন করেন কমবেশি ১০০ আফগানি।

হেরাতের বাইরে যে এলাকার বাসিন্দাদের খাদ্যসংকটের বর্ণনা ওপরে দেওয়া হয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষ দিনমজুরের কাজ করেন। গত কয়েক বছর ধরেই এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।সেখানকার পরিবারগুলো তাদের ক্ষুধা থেকে বাঁচাতে মরিয়া পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।

এ সময় গুলাম হজরত নামের একজন তাঁর হাত পরনে থাকা আলখেল্লার পকেটে ঢুকিয়ে এক পাতা ট্যাবলেট বের করে আনেন। সাধারণত উদ্বেগ–দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এ ওষুধ পথ্য হিসেবে সেবন করার অনুমতি দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।

গুলাম হজরতের ছয় সন্তান। সবচেয়ে ছোটটির বয়স এক বছর। তিনি বলছিলেন, ‘এমনকি এতটুকু বাচ্চাকে এ ওষুধ খাওয়াই আমি।’  অন্যরা ভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট দেখিয়ে বলেন, তাঁরাও তাঁদের বাচ্চাদের খাওয়ান এসব। তাঁরা যেসব ট্যাবলেট দেখালেন, সাধারণত সেসব বিষন্নতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ব্যবহার করেন চিকিৎসকেরা।

এ ব্যাপারে চিকিৎসকেরা বলেন, যেসব শিশু–কিশোর অপুষ্টির শিকার, তাদের এই ওষুধ খাওয়ানো হলে পাকস্থলি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ, ঘুম ও আচরণে বিশৃঙ্খলা।স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে গিয়ে ওই প্রতিনিধিরা দেখেন, ১০ আফগানিতে (আফগানিস্তানের মুদ্রা) বা এক টুকরা রুটির মূল্যে এ ওষুধ কেনা যায়।

তাঁরা কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। জেনেছেন, বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরাই অল্প কিছু রুটি ভাগাভাগি করে খেয়ে টিকে আছেন। একজন নারী তাঁদের বলেন, তাঁরা সকালে শুকনা রুটি খান। আর রাতে রুটি ভিজিয়ে খান; যাতে তা নরম হয়।জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানে এখন এক ‘মানবিক বিপর্যয়’ দেখা দিতে চলেছে।

আম্মার (ছদ্মনাম) নামে ২০–এর কোঠার এক তরুণ বলেন, তিন মাস আগে নিজের কিডনি বেঁচতে তিনি অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। এ সময় শরীরের পেছনে অস্ত্রোপচারের জায়গা ও সেলাইয়ের চিহ্ন দেখান তিনি।

আম্মার বলেন, ‘আমার বাঁচার কোনো বিকল্প পথ ছিল না। শুনেছিলাম, স্থানীয় একটি হাসপাতালে কিডনি বেচাকেনা হয়। পরে আমিও সেখানে গিয়ে কিডনি বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করি। কয়েক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে ফোন আসে সেখানে যাওয়ার জন্য।’

‘তাঁরা (হাসপাতালের লোকজন) কিছু পরীক্ষা করেন। এর পর ইনজেকশন দিয়ে আমাকে অচেতন করেন। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না’, বলেন আম্মার।কিডনি বিক্রি করে আম্মার প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার আফগানি (৩ হাজার ১০০ মার্কিন ডলার) পান। এই অর্থের বেশির ভাগটা চলে যায় পরিবারের খাবার জোগাতে করা ঋণ পরিশোধে।

নিরূপায় হয়ে কিডনি বিক্রি করা এই তরুণ তাঁদের দুর্দশার কথা বলছিলেন, ‘আমরা যদি এক রাত খেতাম, তো পরের রাত না খেয়ে থাকতাম। কিন্তু কিডনি বেচার পর আমার মনে হলো, আমি একজন অর্ধমানব। হতাশ হয়ে পড়লাম। এভাবে চলতে থাকলে, আমার মনে হয়, আমি মরে যাব।’

আফগানবাসীর ক্ষুধার এ কষ্ট দূর করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাওয়া হয় হেরাতে তালেবান সরকারের প্রাদেশিক মুখপাত্রের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি আফগানিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও আফগানদের সম্পদ জব্দ করে রাখার ফল।’ তবে তালেবান সরকার সংকট থেকে উত্তরণে জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button