বিএনপি

কমিটি নিয়ে মহিলা দলে বিদ্রোহ , কমিটিকে মনোরঞ্জন কমিটি আখ্যা , বিএনপিতে তোলপাড়

সম্মেলনের একবছর পর কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মনোয়ারা বেগম মণিকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে জেলী চৌধুরীকে, যারা তৃতীয় দফায় একই পদে এসেছেন। তবে কমিটি ঘোষণার পর পরই বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির এই অঙ্গ সংগঠনটিতে। নতুন কমিটিতে অবমূল্যায়নের অভিযোগে ১৩ জন একযোগে পদত্যাগ করেছেন। বিক্ষুব্ধ নেত্রীরা এই কমিটিকে ‘মনোরঞ্জন ও সিন্ডিকেটের বাণিজ্যিক’ কমিটি আখ্যা দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, রাজপথের কর্মীদের বঞ্চিত করে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ও নগর কমিটির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট তাদের পছন্দের সুবিধাভোগীদের পদ পাইয়ে দিয়েছেন।

একইসঙ্গে তারা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত সচিবের (পিএস) বিরুদ্ধেও সংগঠনে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরের ১০ মার্চ চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ১২ মাস ২০ দিন পর বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) কেন্দ্র থেকে ১৩৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে। এরপর থেকেই মহিলা দলের নেত্রীদের একাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ তুলে ধরছেন, যারা সভাপতির পদ পাওয়া ‘মণিবিরোধী’ হিসেবে পরিচিত।

নতুন কমিটি প্রত্যাখান করে একই পদত্যাগপত্রে সই করা ১৩ নেত্রী হলেন- বিগত কমিটির সহসভাপতি জেসমিনা খানম ও শাহিদা খানম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আঁখি সুলতানা, প্রচার সম্পাদক দেওয়ান মাহমুদা আক্তার লিটা, সাংগঠনিক সম্পাদক গুলজার বেগম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজিয়া বেগম বুলু, সহ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরজু নাহার মান্না, সহ-প্রচার সম্পাদক রোকসানা বেগম মাধু, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ফাতেমা কাজল, সদস্য নাছিমা আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুন নাহার লিজা, সহ-যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েরা বেগম এবং সদস্য নার্গিস বেগম। ঘোষিত কমিটিতে তিন নম্বর সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জেসমিনা খানম। কমিটি ঘোষণার পর তিনি একে ‘মনোরঞ্জন কমিটি’ ও ‘সিন্ডিকেট কমিটি’ আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।

জেসমিনা খানম বলেন, ‘আমি সাবেক একজন কাউন্সিলর। ১৫ বছর ধরে রাজপথে আছি। আমাকে পদোন্নতি দেওয়ার কথা, উল্টো পদাবনতি হয়েছে। প্রমোশন চেয়ে আমি ডিমোশন পেয়েছি। মনোয়ারা বেগম মণির রোষানলে পড়ে আমাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। বক্কর-শামীম ও এক নেতার পিএস গং সংগঠনটাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আমরা চাই সংগঠনে কাজ করতে, আর তারা চায় ব্যবসা করতে। তারা ব্যবসা করার জন্যই তাদের মনোনীত লোকজন দিয়ে এই কমিটি করেছে। আমরা এটা প্রত্যাখান করেছি।’ চার নম্বর সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন সাবেক ছাত্রদল নেত্রী আঁখি সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশনা ছিল, যারা ছাত্রদল করেছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখার জন্য। কিন্তু এই কমিটির মাধ্যমে তারেক রহমানের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। যাকে সভাপতি করা হয়েছে, মনোয়ারা বেগম মণি, তিনি আওয়ামী এজেন্ট। তিনি আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীনের পছন্দের মানুষ।

তিনি পার্টি অফিসে এলে মারামারি হয়, চুলোচুলি হয়। আমরা চাই, আওয়ামী নেত্রী মণি আওয়ামী লীগে চলে যাক।’ তিনি আরও বলেন, ‘শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া সংগঠন মহিলা দল ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দিয়ে চলবে, এটাই আমরা চাই। আ জ ম নাছিরকে ভালোবাসার নেত্রী আমাদের দরকার নেই। আমাদের ফাদার অর্গানাইজেশন বিএনপির অভ্যন্তরীণ একটি সিন্ডিকেট পরীক্ষিতদের বাদ দিয়ে এই কমিটি করেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সেজন্য আমরা পদত্যাগ করছি।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে আলোচনায় আসা দেওয়ান মাহমুদা আক্তার লিটাকে তিন নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে অভিযোগ করে লিটা বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এবং আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের ঘোষিত বিএনপির সকল কর্মসূচিতে আমি আমি রাজপথে থেকেছি এবং এখনও আছি। নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটিসহ আমি মোট সাত মামলার আসামি। তারপরও ভীতসন্ত্রস্ত্র না হয়ে দলের আদর্শ বুকে ধারণ করে আমি রাজপথে সক্রিয় আছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল, প্রাণপ্রিয় সংগঠন আমার এই ত্যাগকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু আমাকে যে পদ দেওয়া হয়েছে, তাতে আমি মানসিক আঘাত পেয়েছি। এজন্য আমি পদত্যাগ করেছি।

তবে সংগঠনের কর্মকাণ্ডে আমি অবশ্যই সক্রিয় থাকব।’ উল্লেখ্য, মনোয়ারা বেগম মণি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (লালখানবাজার, জামালখান ও বাগমণিরাম) সাবেক কাউন্সিলর। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ব্যানারে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মনোয়ারা বেগম মণি তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মেয়র’ এবং ‘আ জ ম নাছির একটি বিপ্লবের নাম’ উল্লেখ করে ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তব্য দেন। এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপিতে তোলপাড় সৃষ্টি হলে নগর মহিলা দলের ওই সময়কার সভাপতি মনোয়ারা বেগম মণিকে বহিষ্কার করা হয়।

২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মণি’র বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং সভাপতির পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে পুনরায় বিএনপির সমর্থনও পেয়েছিলেন। এদিকে, তৃতীয় দফায় নগর মহিলা দলের সভাপতি পদ পাওয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় মনোয়ারা বেগম মণি  বলেন, ‘রাজপথের ত্যাগী এবং সক্রিয় নেত্রীদের নিয়ে একটি ভালো কমিটি হয়েছে। চলমান দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে আমরা অতীতের মতোই সক্রিয় থাকব।’ কমিটি থেকে ১৩ জনের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে অনেক যাচাই-বাছাই করে কমিটি দেওয়া হয়েছে।

যারা মনে করছেন কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠনে নানা মত থাকতেই পারে।’ উল্লেখ্য, বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধে সক্রিয় থেকে মনোয়ারা বেগম মণি কয়েক বার গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। বিভিন্ন কর্মসূচিতে পিকেটিংয়ে অংশ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটার শিকার হয়ে গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন তিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, ‘আমি তো মহিলা দল করি না।

আমি বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। কমিটি দিয়েছে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। আমি তো কমিটি দিইনি। ক্ষোভ থাকলে তাদের জানাক, আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?’ এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করকে ফোনে কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button