অপরাধআইনশৃঙ্খলা বাহিনীঢাকাবাংলাদেশরাজধানী

মিরপুরের অলিগলিসহ পাড়াজুড়ে কিশোর গ্যাং এখন এক মূর্তিমান আতঙ্ক

এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সাধারণ মানুষ তো বটেই; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অনেক সময় ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না উল্টো বিপাকে পড়ার আতঙ্কে। আবার অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদও দিচ্ছে এসব গ্যাংকে। সব মিলিয়ে মিরপুরের অলিগলিসহ পাড়াজুড়ে কিশোর গ্যাং এখন এক মূর্তিমান আতঙ্ক।

তাদের কারও বয়স ১৮ পেরিয়েছে, কারও বা কম। পাড়ায়-মহল্লায় চলাফেরা করে দলবেঁধে। সেসব দলের আবার ভিন্ন ভিন্ন নামও আছে। ‘ডিটিসিবি স্ট্রিট’, ‘জল্লা মিলন গ্রুপ’, ‘রোমান্টিক গ্রুপ’ ‘ভইরা দে’….। এ পর্যন্ত তবু উল্লেখ করা গেল, কিছু নাম তো রুচিতে পর্যন্ত বাধে বলে বলা যায় না।

বেশবাস ওদের যেমনই হোক, আচার-আচরণে হিরোইজম ভাব। হরহামেশাই ইভটিজিংয়ের শিকার কিশোরী-তরুণীরা ওদের দেখলে আঁতকে ওঠে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওদের পেরিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে! এসব দলকে বলা হয় কিশোর গ্যাং। রাজধানীর মিরপুরে এমন সব কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ভীষণভাবেই বেড়ে গেছে।

চুরি, ছিনতাই, লুট, ডাকাতি এমনকি চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ওদের দৌড়। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাঁয়তারা তো রয়েছেই, ওরা এখন জড়িয়ে যাচ্ছে মাদককারবারেও। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে খুন-খারাবি।

সময় যত যাচ্ছে, এসব কিশোর গ্যাং ততই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বয়স কম হওয়ায় সাজা কম; এমনকি আইনেও অনুকম্পা মেলে। তাতে বরং ওদের বাড় বেড়ে গেছে আরও। এহেন দলগুলোকে আবার ছায়া দিচ্ছে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা, ক্ষেত্রভেদে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারা। উপরন্তু জুটেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়াও।

গত ২৩ অক্টোবর মধ্যরাতে মিরপুরের পল্লবী সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকার একটি ভবনে হানা দেয় একদল কিশোর, তরুণ ও যুবক। ভবনের ৫ তলার একটি ফ্ল্যাটে ঢুকে নির্যাতন করা হয় দুই প্রবাসীর স্ত্রীকে। ওয়ারড্রোব-আলমারির তালা ভেঙে লুটে নেওয়া হয় নগদ প্রায় ৩ লাখ টাকা ও বিপুল স্বর্ণ ও রুপার অলঙ্কার।

ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, মিরপুরের ৩নং ওর্য়াড ছাত্রলীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান পারভজের নেতৃত্বে ওই বাসায় প্রবেশ করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এর পর চলে লুটপাট। এ ঘটনায় ৯ জনের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী গৃহবধূ সীমা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এজাহারে নেই ঘটনার মূলহোতা পারভেজের নাম। বাদীর অভিযোগ, পুলিশ জোর করে এজাহার থেকে নাম কেটে দিয়েছে ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুরের পল্লবীর সি-ব্লকে চলে কিশোর গ্যাং রমজান ও আল-আমিন গ্রুপের তাণ্ডব। চাকু দিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী রাকিবকে উপর্যুপরি আঘাত করে গ্যাং দুটির সদস্যরা। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেও অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ।

এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার। এমনকি সাহায্য ছাড়া এখন আর হাঁটাচলাও করতে পারেন না রাকিব। কিন্তু ঘটনায় অভিযুক্তরা এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে জামিনে। এখন মামলা তুলে নিতে ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রাকিবের বাবা আব্দুল্লাহর।

পল্লবী সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী ভুক্তভোগী গৃহবধূ সীমার জানান, ঘটনার প্রাথমিক তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই শফিকুল ইসলামকে তিনি ঘটনার সময়ের ভিডিও ফুটেজসহ বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হোতা পারভেজ ছাড়াও রাজন, শাকিব, জয়, রুহুল, এনায়েত, সোহাগ, কাইয়ুম, লম্বু আশিক ওরফে বিহারি আশিক, রায়হানসহ অচেনা আরও ৫ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু পুলিশ তাকে সাফ জানিয়ে দেয় ছাত্রলীগ নেতা পারভেজের নাম বাদ না দিলে মামলাই নেওয়া হবে না। এর পর পুলিশ মামলার এজাহার লিখে দিলে তাতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন তিনি। সীমা বলেন, মামলা করে উল্টো বিপাকে আছি। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের ধরছে না।

মামলা করে মালামাল ফেরত এমনকি নির্যাতনের বিচার তো পেলামই না; উল্টো আসামিরা মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ফলে পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা।অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ছাত্রলীগ নেতা পারভেজ বলেন, ওই ভবনে গ্যাঞ্জাম হচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ভবন মালিকের ডাকেই সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম।

যাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে বা যারা করেছে তাদের কারোর সঙ্গেই আমার সম্পৃক্ততা নেই। এটা তদন্ত করে পেয়েছে বলেই পুলিশ আমার বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি। রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতেই একটি মহল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত সন্ধ্যায় কথা হয় পল্লবী থানার এসআই শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। গৃহবধূ সীমার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও তিনি। প্রথমে তিনি মামলার বিষয়ে কথা বললেও ভিডিওতে ছাত্রলীগ নেতাকে দেখা গেলেও মামলার এজাহারে তার নাম না থাকার বিষয়ে বাদীর অভিযোগের প্রসঙ্গ এসআই শফিকুল কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

মিরপুর অ্যাভিনিউ-৫ এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী পাপিয়া আক্তার সম্প্রতি মিরপুরের কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়কের দপ্তরে। অভিযোগে পাপিয়া উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন ধরে কিছুসংখ্যক কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব মিরপুরবাসীর জনজীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে।

তারা ছিনতাই করে, ইয়াবা বিক্রি করে, গাঁজা বিক্রি করে, রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের সময় তাদের থেকে ছিনতাই করে এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া মেয়েদের ইভটিজিং করে। তারা মোবাইল ছিনতাই করে এনে এখানে বিক্রি করে।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর সকালে মাদক বিক্রির সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি মানা করলে তারা আমার হাতের মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে যায়। পরে আমি মোবাইল আনতে গেলে আমার গায়ের ওড়না টান দেয়। এর পর তাদের গ্রুপের সদস্য রাজন, বাবু ওরফে ঘাড় কাটা বাবু, আলামিন, রাব্বি, সজিব ওরফে নারিকেল সজিব, জাবেদ, আকাশ, নাটা খোকন, বুুস ওরফে অটো রিকশা বুস, ইমন ওরফে ড্যান্সার ইমনসহ আরও অন্তত ৮ জন বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে ২৫ নং লাইনে একত্রিত হয়।

তারা প্রতিদিন একত্রে হয়ে মাদকদ্রব্য বেচাকেনা করেন। আমরা তাদের বাধা দিতে এলে আমাদের গায়ে হাত তুলতে আসে; বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধমকি দেয়। যার কারণে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না। এমনকি তারা অস্ত্রও বিক্রি করে। বহুবার থানা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েও আমরা বিচার পাইনি। তাই কিশোর গ্যাংদের হাত থেকে বাঁচতে র‌্যাবের শরণাপন্ন হলাম।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোরদের একত্রিত করে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী এলাকার প্রভাবশালী কথিত বড় ভাইয়েরা তাদের বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন।

সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের ভাড়ায় খাটিয়ে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করাচ্ছে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না।

আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ালেও এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোরদের বিপথগামিতা থেকে ফেরানো অসম্ভব বলেও জানান তিনি।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button