Bangla Newsঅর্থ ও বাণিজ্যএক্সক্লুসিভজাতীয়বাংলাদেশ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন সাধারণ মানুষ

আমরা এখন নিজেদের মধ্যবিত্ত দাবি করতে পারি না। দ্র্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ক্রমশ: নিম্ন মধ্যবিত্তে পরিণত হয়ে গেছি। আমাদের যা সঞ্চয় ছিল তা করোনায় ভেঙে খেয়েছি। এখন সঞ্চয় শেষ, মাঝে-মধ্যে ঋণ করতে হচ্ছে। কথাগুলো বলছিলেন শুভ্র দাস। তিনি রাজধানীর কেপিবি স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক।

দশ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। তার এই কর্মজীবনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের কবলে পড়েছিলেন করোনাকালীন সময়। সেই ধাক্কা এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখন নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি তাকে কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শুভ্র দাস জানান, করোনাকালীন সময়ে তার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। তখন যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। আত্মীয়দের থেকে ঋণও করেছিলেন। কিন্তু বাবাকে বাঁচাতে পারেননি। সেই ঋণের বোঝা এখনও টানছেন তিনি। 

শুভ্র দাসের পরিবারে মা, স্ত্রী, এক সন্তান ও ছোট ভাই মিলিয়ে পাঁচ সদস্য। তাদের সকলের দেখভালের দায়িত্ব তার। কলেজের বেতন ও টিউশনি মিলিয়ে তার মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই তার সংসারের খরচ বহন করতে হয়। তবে দিন দিন তা খুবই দুরূহ হয়ে উঠছে। শুধু ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাসও পানির বিল বাবদ তার মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া প্রতি মাসে বাজার খরচ হয় ১৭-১৮ হাজার টাকা।

ইন্টারনেট, মোবাইল, ডিশ বিল ইত্যাদি মিলিয়ে ২ হাজার টাকা ও বাসা থেকে কলেজে যাতায়াত আর আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে আরও ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ২-৩ হাজার টাকা ও এক বছরের শিশুসন্তানের জন্য আরও ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়।

শুভ্র দাস বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আমাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় মিলছে না। আগে কখনো বাহিরে প্রাইভেট পড়ানোর চিন্তা করতাম না। কিন্তু এখন তা করা লাগছে। নইলে আমার ব্যয় সমন্বয় করা যাচ্ছে না। রেগুলার ইনকাম দিয়ে চলা যাচ্ছে না। এটা শুধু আমার না। আমার মতো সকল শিক্ষকের এই অবস্থা। 

কাঠফাটা রোদ। বাসাবো বৌদ্ধমন্দির মহাসড়কে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন ইলিয়াস হোসেন। তার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। পাশেই একটি সিএনজি রাখা। তিনি চালক। খুব একটা যাত্রী পাননি ইলিয়াস। আধাবেলা পেরিয়ে গেলেও তার ‘জমা’র টাকা হয়নি। এজন্যই তিনি চিন্তিত। জানান, প্রতিদিন তাকে এক হাজার টাকা জমা দিতে হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক ৬০০-৭০০ টাকা আয় হয়।

ইলিয়াস হোসেন ঢাকার মিরপুর-৬ এ একটি  মেসে ভাড়া থাকেন। তার পরিবারের সবাই থাকেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায়। সেখানে স্ত্রী ও দুই মেয়ে থাকেন। দু’জনই লেখাপড়া করেন। বড় মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ১মবর্ষে আর ছোট মেয়ে নার্সারিতে পড়ে। ইলিয়াসের মাসিক আয় ২০-২২ হাজার টাকা। 

এই টাকা থেকে তার ঢাকায় মেসে থাকা আর খাওয়া বাবদ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এই টাকা থেকে শুধু দুই সন্তানের লেখাপড়ার জন্যই মাসে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে চাল-ডাল-তেলসহ যাবতীয় বাজার খরচ চলে। তবে তা যথেষ্ট নয়।

কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও এখান থেকেই খরচ করতে হয়। মাঝে-মধ্যে ঋণও করতে হয় আত্মীয়দের থেকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন ইলিয়াস। গ্রামে যে টাকা পাঠান তা দিয়ে সংসার চালানোয় বিড়ম্বনায় পড়েন তার স্ত্রী। প্রায় বলেন টাকা বাড়িয়ে পাঠাতে। কিন্তু ইলিয়াসের আয় থেকে এর বেশি টাকা পাঠানো সম্ভবও হয় না। তাই বাজার খরচ কমিয়ে চেষ্টা করেন দিন পার করার।

শুধু ইলিয়াস হোসেনই নন, এমন অনেক মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। নির্ধারিত আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাসের বেতনে মাসের খরচ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ধারদেনা করতে হচ্ছে। না হয় খরচ কমিয়ে টিকে থাকার বিকল্প পথ বেছে নিতে হচ্ছে। টানা চাপে থেকে হতাশা ভর করছে অনেকের মাঝে। 

বাজার করতে আসা গৃহিণী মনিরা বেগম বলেন, সংসার চালানো তো দূরের কথা এখন জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একমুঠো শাক ২০ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এদিকে মোটামুটি ভালো চাল কিনতে গেলে ৭০-৭৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। এক লিটার তেল দিয়ে কয়েকদিন যায়। গত কয়েক মাস ধরে অল্প তেলে রান্না করি।

আরেক গৃহিণী হালিমা বেগম বলেন, আমার স্বামী একটি কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে চাকরি করে। ঘর ভাড়া দিয়ে কিছুই থাকে না। ছেলেমেয়ে এটা-ওটা খেতে চায় কীভাবে তাদের সামনে দেবো। বড় ছেলেকে বাসায় একজন শিক্ষক এসে পড়াতো তাকে ছেড়ে দিয়েছি শুধু এই কারণে। তার বেতন ঠিকমতো দিতে পারতাম না। ছেলের স্কুলের বেতন ঠিকমতো দিতে পারি না।

টাইলসের কাজ করেন রাজু আহমেদ। তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় থাকি এই রকম দুর্ভোগ আগে দেখিনি। মাঝে-মধ্যে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করি। দুই সন্তান নিয়ে আর পারছি না। মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু মাস শেষ হওয়ার আগে বাসা ভাড়া ও বাজার খরচ দিলেই টাকা শেষ। ছোট ছেলেটা কৌটার দুধ খায় সেটারও বাড়তি দাম।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button