Bangla News

মঙ্গল গ্রহে বায়ুমণ্ডলের অবস্থা শোচনীয়, রয়েছে শুকনো নদী

উচ্ছ্বাস তৌসিফ : দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে মানব বসতি তৈরির কথা ভাবছেন। লাল এ গ্রহটি থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একসময় এ গ্রহে পানি ছিল, ছিল জীবন ধারণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল। কিন্তু আজ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের অবস্থা শোচনীয়। নিতান্ত পাতলা, শীতল। কেন এমন হলো? তার আগে আসুন জেনে নিই, মঙ্গলে পানির অস্তিত্ব ছিল, সেটা কীভাবে বুঝলেন বিজ্ঞানীরা?

বেশ কিছু অভিযান চালানো হয়েছে মঙ্গলে। অপরচুনিটি (২০০৪) থেকে শুরু করে বিখ্যাত কিউরিসিটি (২০১২) কিংবা হালের পার্সিভিয়ারেন্স (২০২০)—সব অভিযানের লক্ষ্য ছিল মূলত দুটো। এক, মঙ্গলকে আরও ভালোভাবে জানা। আর দুই, গ্রহটি কতটা মানুষের বসতি করার উপযোগী, তা খতিয়ে দেখা।

দেখা গেছে, মঙ্গলে রয়েছে শুকনো নদী। মঙ্গলপৃষ্ঠের লাল মাটির গভীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে মার্স রোভারগুলো। শুকনো নদীর গভীরে পাওয়া গেছে ম্যাগনেশিয়াম, লোহা ও ক্যালসিয়াম সালফেটের মতো খনিজ। এরকম বেশ কিছু খনিজ ইঙ্গিত করে, একসময় পানি ছিল এখানে। কারণ, পানিহীন অঞ্চলে এসব খনিজ পাওয়া যায় না।

আজকের লাল গ্রহ কি এককালে সবুজ বা নীল ছিল? পানির পরিমাণ কি বেশি ছিল, নাকি কম? এসব নিয়ে গবেষণা এখনো চলমান। তবে পানি যদি থেকে থাকে কোনোকালে, সেজন্য বায়ুমণ্ডল হতে হবে অনেকটাই পৃথিবীর মতো। অথচ বর্তমানে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর ১ শতাংশেরও কম। তাহলে, কীভাবে হলো এমন পরিবর্তন? জানার জন্য মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০১৩ সালের নভেম্বরে একটি নভোযান উৎক্ষেপণ করে। মার্স অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল ইভোলিউশন বা ম্যাভেন নামের এই নভোযান মঙ্গলের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। তথ্য সংগ্রহ করে ম্যাভেন, পাঠায় পৃথিবীতে। এসব তথ্য থেকে জানা যায় আশ্চর্য এক তথ্য।

জানা যায়, আসলেই এককালে মঙ্গলে ছিল পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল। বহতা পানির স্রোতস্বিনী উৎস ধারণের উপযোগী ছিল মঙ্গলের পরিবেশ। বায়ুমণ্ডল ছিল পানিচক্র গঠন, সমুদ্র গড়ে তোলা বা জীবন বাঁচিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট পুরু। কিন্তু মঙ্গলের এ বায়ুমণ্ডলে প্রায়ই হামলা করত সৌরঝড়। সূর্যের নির্মম রশ্মির চার্জিত কণারা ছুটে আসত প্রচণ্ড বেগে। ধাক্কা দিয়ে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের বেশিরভাগ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে বের করে দিত মহাকাশের মহাশূন্যে।

কিন্তু কেন এমন হলো? আর মঙ্গলে যে এমন হলো, পৃথিবীতে হয়নি কেন?

মঙ্গলের ভর পৃথিবীর তুলনায় অনেকটা কম, ঘনত্বও কম। এই দুইয়ে মিলে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা কমে গেছে অনেক দ্রুত। ফলে মঙ্গলের কেন্দ্রের বাইরের দিকটা জমাট বেঁধে গেছে।

এর কারণ, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। এই অদৃশ্য প্রতিরক্ষা বলয় সুরক্ষা দিচ্ছে আমাদের অতন্দ্র প্রহরীর মতো। সূর্য থেকে চার্জিত কণারা যখন ছুটে আসে, আঘাত করতে চায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে, তখন সেগুলোকে বাধা দেয় চৌম্বকবলয়। যেহেতু এ কণারা চার্জিত, তাই চৌম্বকক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ এগুলোর ওপরে কাজ করে। এরা বাধা পায়, ক্ষতি করতে পারে না পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে এসব কণাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই দেখা যায় বর্ণিল মেরুপ্রভা।

এই চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয় কীভাবে? আমরা শুনেছি, পৃথিবী একটি দ্বিমেরু দণ্ডচুম্বকের মতো। এই সব রহস্যের জড় লুকিয়ে আছে পৃথিবীর গহীন কেন্দ্রে। এখানে রয়েছে তরল লোহা। এই লোহার স্রোত পাক খায় পৃথিবীর ঘুরপাকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয় প্রবাহমান গলিত লোহার স্রোতে। এই তড়িৎ প্রবাহ-ই তৈরি করে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। এই ক্ষেত্র আবার শক্তি জোগান দেয় গলিত লোহার স্রোতে। এভাবে গড়ে উঠেছে ভূ-ডায়নামো, পৃথিবীর চৌম্বকবলয়ের নেপথ্যের কারিগর। এই ভূ-ডায়নামো পৃথিবীকে পরিণত করে উত্তর-দক্ষিণ মেরুবিশিষ্ট বিশাল এক দণ্ড চুম্বকে।

এরকম বৈশ্বিক চৌম্বকক্ষেত্র গড়ে ওঠার জন্য রয়েছে কিছু বিশেষ শর্ত। যেমন গলিত কেন্দ্র থাকার মতো বড় হতে হয় একটি গ্রহকে। কারণ, যথেষ্ট ভর থাকলে কেন্দ্রে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড তাপমাত্রা। এর ফলেই কেন্দ্রের খনিজ গলিত অবস্থায় থাকে। পাশাপাশি, গ্রহটিকে যথেষ্ট দ্রুত ঘুরতে হয় ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বা চৌম্বকবলয় সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টির জন্য। এর সব হয়েছে বলেই রয়েছে পৃথিবীর এই চৌম্বকবলয়।

মঙ্গলের ভর পৃথিবীর তুলনায় অনেকটা কম, ঘনত্বও কম। এই দুইয়ে মিলে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা কমে গেছে অনেক দ্রুত। ফলে মঙ্গলের কেন্দ্রের বাইরের দিকটা জমাট বেঁধে গেছে। ফলে ধীরে ধীরে জমে গেছে ভেতরের গলিত লোহাও। গলিত লোহা যখন পরিণত হলো কঠিন লোহায়, তখন এতে আর স্রোত ওঠার উপায় নেই, ফলে তৈরি হয়নি কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ। ফলে মঙ্গলের ভূ-ডায়নামো অকার্যকর হয়ে গেছে। উধাও হয়ে গেছে গ্রহটির চৌম্বকবলয়। সেটা আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগের কথা।

ওদিকে, সূর্য তখন আরও তরুণ। নিয়ত উগরে দিচ্ছে গনগনে সৌরবায়ু। এই বায়ুর পিঠে ভর করে ছুটে আসছে উচ্চ শক্তির চার্জিত কণারা। তারা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের গ্যাসগুলোকে। এভাবে ধীরে ধীরে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পাতলা হয়ে গেছে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে শুকিয়ে গেছে মঙ্গলের পানি। পুরো গ্রহটি হয়ে গেছে লাল, রুক্ষ মরু।

আমাদের সৌভাগ্য, পৃথিবীর ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি। আমাদের নীল এই গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র আজও আমাদের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।

লেখক: উচ্ছ্বাস তৌসিফ, সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা, উইকিপিডিয়া, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button