Bangla News

দরজার ওপাশে গুপ্তধন, বাধা দুই বিষাক্ত গোখরা

মূল্যবান সম্পদ কিংবা ধন-দৌলত পাহাড়ার জন্য আজকাল বিশেষ বাহিনী রয়েছে। টাকার বিনিময়ে তারা পাহাড়া দেয়। অনেকে সম্পদ নিরাপদ রাখতে এই বাহিনীর উপর ভরসাও করেন। কিন্তু যদি বলা হয় মূল্যবান সম্পদ সাপ পাহাড়া দিচ্ছে- কথাটি বিশ্বাস করবেন না অনেকেই। কিন্তু অনেকের বিশ্বাস ঘটনাটি সত্য। বিশেষ করে রূপকথায় যখন আমরা এ ধরনের গল্প পাই, তখন বাস্তবে সেই বিশ্বাস জোড়ালো হতে সাহায্য করে বৈকি।

দরজায় তালা কিংবা লক করার কোনো সিস্টেম নেই, নেই সিসি ক্যামেরা কিংবা পাহাড়াদার। দরজার গায়ে খোঁদাই করা রয়েছে দুটি বিষাক্ত গোখরা সাপ। এই দরজার পেছনেই না কি লুকানো রয়েছে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ সব ধন সম্পত্তি। এক কথায় কুবেরের ধন। হাজার বছরেও কেউ খোলেনি সেই দরজা। অনেকে যে চেষ্টা করেননি তা নয়। তারা সফল হননি।

কী আছে এই রহস্যময় দরজার পেছনে? ভারতের কেরালার প্রাচীন পদ্মানাভস্বামী মন্দির যেন সবার কাছে এক রহস্যের নাম! কেরালার রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ইস্ট ফোর্টের ভেতরে শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দির অবস্থিত। কেরালীয় এবং দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণে তৈরি মন্দির। কথিত আছে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির।

মন্দিরটির ইতিহাস খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর। ভারতের দিব্য দেশমের বিষ্ণুর ১০৮টি পবিত্র মন্দিরের মধ্যে এটি অন্যতম। দিব্য দেশম হলো তামিল আরভারস (সাধু) রচিত গ্রন্থে ভগবান বিষ্ণুর পবিত্রতম স্থান। এই মন্দিরের মূল দেবতা ফণা তুলে থাকা অনন্তনাগের ওপরে আধশোয়া অবস্থায় বিষ্ণু। এই মন্দির কখনও কখনও গোল্ডেন টেম্পল বা ‘স্বর্ণ মন্দির’ নামেও ডাকা হয়। বস্তুত সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরের কোষাগার ভরে আছে অতুল ঐশ্বর্যে।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে কেরালার মধ্য ও দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যের শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি ষোলো শতকে স্থাপিত হয়। প্রাচীন তামিল সাহিত্য ‘সঙ্গম সাহিত্য’ থেকে এই মন্দিরের কথা জানা যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছরের মধ্যে এই সাহিত্য রচিত হয়েছিল। ত্রিবাঙ্কুরের প্রসিদ্ধ রাজাদের মধ্যে অন্যতম মার্তণ্ড বর্মা এই মন্দিরটির প্রমুখ সংস্করণ করেন এবং বর্তমান শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দিরটির কাঠামো তিনিই তৈরি করেন। মার্তণ্ড বর্মা এই মন্দিরে মুরাজাপম (মুরাজাপম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো নিরবচ্ছিন্ন স্তোত্র পাঠ, এটি এখনও প্রতি ছ’বছর অন্তর পালন করা হয়) এবং ভদ্রা দীপম উৎসবের প্রচলন করেন।

১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে মার্তণ্ড বর্মা ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যটিকে ভগবান পদ্মনাভর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। মার্তণ্ড বর্মা শপথ নেন যে রাজপরিবার ভগবানের তরফে রাজ্যপাট পরিচালনা করবে এবং তিনি ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা রাজ্যের সেবা করবে পদ্মনাভ দাস নামে অর্থাৎ ভগবান পদ্মনাভর দাস হিসেবে। তখন থেকে ত্রিবাঙ্কুরের সব রাজার নামের আগে পদ্মনাভদাস কথাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

পদ্মনাভস্বামীকে ত্রিপদিদানমও বলা হয়। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি যেখানে অবস্থিত সেটি সপ্ত পরশুরাম ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম। মন্দিরটি পবিত্র পুকুর ‘পদ্ম তীর্থম’, যার অর্থ হলো পদ্ম ঝরনার পাশে অবস্থিত। বর্তমানে মন্দিরটি ত্রিবাঙ্কুরের রাজপরিবারের নেতৃত্বে একটি অছি পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়।

শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দিরের দেবমূর্তিটি এর গঠনশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। মন্দিরের ভেতরে ফণা তুলে থাকা অনন্তনাগের ওপরে শায়িত অবস্থায় বিষ্ণুর ১৮ ফুটের এক বিরাট মূর্তি রয়েছে।

ধারণা করা হয়, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ সম্পদ এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে। যা গণনা কিংবা হিসেব করা সম্ভব নয়। এত সম্পদ একত্রে নেই বিশ্বের আর কোথাও। এই ঘটনা নিছক যে রূপকথা নয় তার প্রমাণ মেলে ২০১১ সালে। জনস্বার্থে একটি মামলার জন্য এই মন্দির খোলার নির্দেশ দেয় আদালত। মন্দিরে রয়েছে ছয়টি গুপ্ত প্রকোষ্ঠ। মন্দিরের পশ্চিম অংশে গর্ভগৃহের কাছে এসব প্রকোষ্ঠ রয়েছে। এগুলোর রয়েছে আলাদা নাম ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’ ‘ই’ এবং ‘এফ’। এরপর ভেতরে গিয়ে দেখা যায় ছয়টি নয় রয়েছে আরও দুইটি প্রকোষ্ঠ যার নাম ‘জি’ এবং ‘এইচ’।

‘সি’ ‘ডি’ ‘ই’ এবং ‘এফ’ প্রকোষ্ঠগুলো বছরের নির্দিষ্ট সময় খোলা হয়। প্রয়োজনীয় ধনসম্পদ কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।

২০১১ সালে পুলিশ অফিসার টিপি সুন্দরাজন সুপ্রীম কোর্টে এক পিটিশন দাবি করেন। এরপর সাত জনের একটি বিশেষ দল মন্দিরের সম্পদ জানার জন্য কাজ শুরু করে।
২০১১ এর ৩০ জুন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খোলা হয় এর ভল্ট ‘এ’। সেই কক্ষে ঢুকতে প্রথমে ভাঙা হয় লোহা এবং কাঠের দরজা। তারপর দেখা যায় পাথরের ভারী ফলক। সেই কক্ষের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখা যায় গুপ্তধন। প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া যায় সেখানে। সেখানে ছিল এক লাখ দুই হাজার প্রকারের জিনিসপত্র। কক্ষ ‘ডি’ তে ছিল ৬১৭ ধরনের দ্রব্য। তার মধ্যে ছিলো শ্রীবিষ্ণুর চার ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া সোনার মূর্তি। সোনার বিগ্রহে খোদাই করা দামি রত্ন। বিশেষ অনুষ্ঠানে পরানোর জন্য আছে সনাতনী পোশাক ‘আঁখি’। সম্পূর্ণ সোনার তৈরি মোট ১৬টি পাল্লার এই পোশাকের ওজন ৩০ কেজি। দেবতার অঙ্গভূষণ হিসেবে ছিল ১৮ ফুট লম্বা সোনার হার। ছিলো সোনার তৈরি ধানের ছড়া, যার ওজন ৫০০ কেজি। এছাড়াও ছিল সোনার ওড়না যার ওজন ৭৬ কেজি, মধ্যযুগের সোনার মুদ্রা আছে ৬০০ কেজি ওজনের, আছে মোট ১২০০টি সরগুলি যাতে বসানো থাকে দামি পাথর, অসংখ্য সোনার নেকলেস, কোমরের বিছা, হিরে, চুনি, পান্না, পোখরাজ ইত্যাদি।

তবে কত শতাব্দী ধরে এসব এই মন্দিরে আছে জানে না কেউ। সব কক্ষ খুললেও কেউ কখনও খোলেনি ‘বি’। কারণ এই কক্ষ খুলতে গেলেই নেমে আসবে দেবতার অভিশাপ এমনটাই বিশ্বাস সবার।

২০১১ সালের জুলাই মাসে খোলার চেষ্টা করা হয় ‘বি’। প্রথমে লোহার গ্রীলের দরজা খুলে ভেতরে গেলে দেখা মেলে কাঠের দরজা। এরপর সেটি ভাঙলে দেখা যায় সাপের মূর্তি সংবলিত দরজা। অনেক চেষ্টা করেও ভাঙা যায়নি এই দরজা। এই কাজ শেষ না হওয়ার আগেই মারা যান দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার। এরপর বন্ধ থাকে কাজ। অনেকেই ধারণা করেন, এই দরজা খোলা হলে রাজ্যের উপর নেমে আসবে অভিশাপ কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী।

প্রচলিত আছে, থাম্পি রাজা সেনারা এই মন্দির লুটপাট করতে এলে ‘বি’ ভোল্টের কাছে যাওয়ার পর অজস্র সাপ তাদের তাড়া করতে থাকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেই থেকে বিশ্বাস করে যে, প্রাচীনকালের সিদ্ধপুরুষরা নাগবন্থম মন্ত্র জপে এই মন্দির বন্ধ করে রেখেছেন। সেই বিশেষ মন্ত্র জানলেই খুলবে এই মন্দিরের দরজা। দরজার কান পাতলে সাপের ছোবল ও পানির শব্দ শুনতে পান ভক্তরা। এটি মহাপ্রলয়ের ইঙ্গিত বলে মনে করেন ভক্তরা। কখনো এই দরজা খোলা হলে বানের জলে পৃথিবী ভেসে যাবে বলেও ভক্তদের বিশ্বাস।

Flowers in Chaniaগুগল নিউজ-এ বাংলা ম্যাগাজিনের সর্বশেষ খবর পেতে ফলো করুন।ক্লিক করুন এখানে

Related Articles

Back to top button